Menu

অষ্টাদশ শতাব্দীর বৈষ্ণব পদ সংকলন গ্রন্থ

Last Update : January 12, 2024

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের (প্রাগাধুনিক পর্যায়) বৈষ্ণব সাহিত্যের আলোচনায় বৈষ্ণবপদ সংকলন গ্রন্থের প্রসঙ্গ আলোচনা অবশ্য কর্তব্য। এই লেখায় উল্লেখযোগ্য পদসংকলন গ্রন্থের সাধারণ আলোচনার পাশাপাশি অপ্রধান কিছু সংকলন গ্রন্থের আলোচনাও সংযোজিত হয়েছে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর বৈষ্ণব পদ সংকলন গ্রন্থ

সাধারণ আলোচনা

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের প্রচারিত বৈষ্ণবীয় প্রেমধর্মের প্রভাবে বাংলার রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে এবং বাংলা সাহিত্যে বিরাট এক পরিবর্তন সূচিত হয়। তাঁর পবিত্র জীবনাদর্শের প্রভাবে দীর্ঘকাল বাংলা সাহিত্যে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক প্রেম পদাবলী রচিত হয়ে জনগণের রসতৃষ্ণাকে চরিতার্থ করে। তবে মনে রাখতে হবে বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধাকৃষ্ণের যে অপ্রাকৃত প্রেমলীলার বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছে তার লীলাস্থল ভাববৃন্দাবন, এই ভৌম বৃন্দাবন বা প্রাকৃত জগৎ নয়। দ্বিতীয়ত রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার মধ্যে তত্ত্ব ও ভাবাদর্শগত যে সমাজবিগর্হিত প্রেমের সম্বন্ধ রয়েছে চৈতন্যতিরোধানের পর বিরাট চারিত্র্যশক্তির অভাবে যেখানে আদর্শহীনতায় নীতি বিপর্যয় ঘটে। সমকালীন রাষ্ট্রিক ঘূর্ণাবর্তে জনসাধারণও ভাববৃন্দাবনে আর আস্থা রাখতে পারেননি। গতানুগতিক ভাবে এসময়ে বহু কবি রাধাকৃষ্ণের পদাবলী রচনা করতে প্রয়াসী হন বটে, কিন্তু তাঁরা তেমন কিছু কবিশক্তির পরিচয় দিতে পারেননি। তাঁদের রচনায় কল্পনাশক্তির গভীরতা বা ভাবভাবনার কোনো আন্তরিকতার পরিচয় মিলে না। নিতান্ত কৃত্রিম কলাকৌশলে তাঁদের রচনা নিতান্ত জড় ও নিষ্প্রাণ বস্তুতে পরিণত হয়েছে। সুখের বিষয় এই শতাব্দীতে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছোট বড় বৈষ্ণব পদসংকলন গ্রন্থ রচিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেগুলির মূল্য অপরিসীম। কারণ, সেগুলি না পেলে বহু বড় বড় কবির কালজয়ী সৃষ্টিগুলি কোথায় হারিয়ে যেত। বৈষ্ণবপদ সংকলন গ্রন্থগুলি বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যকে বিস্মৃতির কবল থেকে রক্ষা করে বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। বৈষ্ণব সাহিত্যের অনেক উৎকৃষ্ট পদ রক্ষা পেয়েছে। ঐতিহাসিক বিচারে এর মূল্য অপরিসীম। বৈষ্ণব পদ সংকলন গ্রন্থগুলি আবিষ্কৃত ও সংকলিত হওয়ায় বিভিন্ন কবিদের প্রতিভার স্বরূপ নির্ণয় এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাদের অবদান সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ পাওয়া গেছে।

বৈষ্ণবপদ সংকলন গ্রন্থের আলোচনা

বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ‘ক্ষণদাগীত চিন্তামণি’ :

এই গ্রন্থটি বৈষ্ণবপদ সংকলনের আদি গ্রন্থবিশ্বনাথ চক্রবর্তী আনুমানিক ১৬৬৪ খ্রীষ্টাব্দে নদীয়া জেলার দেবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সংস্কৃত সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্রে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি তেইশটি সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলির মধ্যে টীকাগ্রন্থ, কাব্যগ্রন্থ ও অলংকার বিষয়ক গ্রন্থ রয়েছে। তাঁর বিশেষ কীর্তি ‘সাহিত্যদর্পণ’ ও ‘উজ্জ্বনীলমণি‘-র টীকা। বৈষ্ণব সাহিত্যে রূপগোস্বামী ও কবিকর্ণপুরের পরে তাঁকে স্থান দিতে হয়। সংস্কৃত রচনা বাদ দিলে বাংলা ভাষায় রচিত কিছু পদ ও বৈষ্ণবপদ সংকলন ‘ক্ষীণদাগীতচিন্তামণি’ উল্লেখযোগ্য। বৈষ্ণবপদে তিনি হরিবল্লভ বা বল্লভভণিতা ব্যবহার করেছেন।

বিশ্বনাথ চক্রবর্তী সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যতম বৈষ্ণব দার্শনিক। তরুণ বয়সে বিবাহ করেও সংসার ত্যাগ করে বৃন্দাবন চলে যান। অল্প বয়সেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বৃন্দাবন-বাস কালেই তিনি এই সংকলন গ্রন্থ তৈরী করেন। 

গবেষক পণ্ডিতদের মতে বিশ্বনাথ ১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দে এই গ্রন্থ প্রস্তুত করেন। পূর্ব ও উত্তর বিভাগ—এই দুই খণ্ডে তিনি সংকলন গ্রন্থটি সম্পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। বোধ হয় আকস্মিক মৃত্যু বা অন্য কোনো কারণে তিনি উত্তর খণ্ড শেষ করতে পারেননি। আমরা কেবল পূর্ববিভাগ পেয়েছি।

‘ক্ষণদা’-র অর্থ রাত্রি। এই গ্রন্থে এক মাসের প্রতি রাত্রির উৎসব সংক্রান্ত পদ তিরিশটি ‘ক্ষণদা’য় সংকলিত। নায়ক-নায়িকার বিভিন্ন পর্যায় অনুসারে পঁয়তাল্লিশজন কবির তিন শতকেরও বেশি পদ এতে সংকলিত। নিজের ভণিতায় চল্লিশটি ব্রজবুলি পদ সংকলিত। বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস প্রভৃতি কবির পদ রয়েছে। চণ্ডীদাস বাদ পড়েছে। এর কারণ নির্ণয় করা কঠিন। সপ্তদশ শতাব্দীতে চণ্ডীদাস খুব জনপ্রিয় ছিলেন। তা সত্ত্বেও চণ্ডীদাসকে বেন তিনি গ্রহণ করলেন না তা চিন্তার বিষয়। পূর্বেই বলা হয়েছে বিশ্বনাথ ক্ষণদার উত্তর বিভাগ সংকলন করতে প্রয়াসী ছিলেন। হয়তো ক্ষণদার উত্তরখণ্ডে চণ্ডীদাসকে নিয়ে আসতেন।

আরো পড়ুন--  বৈষ্ণব কবি রায়শেখর, 16শ শতকের কবি

নরহরি চক্রবর্তীর ‘গীতচন্দ্রোদয়’ ও ‘গৌরচরিত্র চিন্তামণি’ :

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নরহরি চক্রবর্তী বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন পণ্ডিত লেখক ছিলেন। তিনি নানা শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ও সঙ্গীত শাস্ত্রের আচার্য ও কবি ছিলেন। বৈষ্ণব সমাজ সম্প্রদায়ের প্রকৃত ইতিহাসকার নরহরি চক্রবর্তী। তাঁর ‘ভক্তি রত্নাকর‘ ও ‘নরোত্তমবিলাস‘ – উক্ত বিষয়ের দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাঁর ‘গীতচন্দ্রোদয়‘ ও ‘গৌরচরিত্র চিত্তামণি’—দুটি পদসংকলন গ্রন্থ। ‘গীতচন্দ্রোদয়ে’ সমস্ত পদকে আট অংশে বিভক্ত করে নানা আস্বাদ বা উপবিভাগে বিন্যাস করার পরিকল্পনা তিনি নেন। সঙ্গীত শাস্ত্র বিশারদ নরহরি এতে সঙ্গীত বিষয়ক নানা তত্ত্ব পরিবশেন করতে প্রয়াসী হন। ‘গৌরচরিত চিন্তামণি তে ৩৭১টি গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ সংকলিত হয়েছে। দুঃখের বিষয় এই সংকলন গ্রন্থটির তেমন প্রচার হয়নি।

রাধামোহন ঠাকুরের ‘পদামৃত সমুদ্র’:

রাধামোহন ঠাকুর শ্রীনিবাস আচার্যের প্রপৌত্র। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে (১৭২৫ খ্রীঃ) ‘পদামৃত সমুদ্র’ শীর্ষক পদ সংকলন প্রস্তুত করেন। পাণ্ডিত্য, কবিপ্রতিভা ও বৈষ্ণব শাস্ত্রাদিতে প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী রাধামোহন বৈষ্ণবগুরু হিসেবে হিন্দু ও বৈষ্ণব সমাজে এক শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি পান। ইতিহাসখ্যাত মহারাজ নন্দকুমার তাঁর শিষ্য ছিলেন।

‘পদামৃত সমুদ্রে’ মোট ৭৪৬টি পদ সংকলিত হয়েছে। তাঁর নিজের ২৩৮টি পদ স্থান পেয়েছে। কবি গোবিন্দদাস ও রাধামোহনের কবিতা মিলে মোট পদসংখ্যা পাঁচশ-এর মতো। অন্যান্য পদকর্তাদের মাত্র আড়াইশ পদ গৃহীত হয়েছে।

এই পদসংকলনে রাধামোহনের বিশেষ মানসিকতার পরিচয় মেলে। কীর্তনগানে শ্রোতাদের চিত্ত আকর্ষণের উপযোগী ঝঙ্কারমুখর আলঙ্কারিক কলানৈপুণ্য পদগুলি তিনি সংকলন করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য গোবিন্দদাসের পদের সংখ্যা বেশি।

সমালোচকদের মতে এই সংকলনে ভারসাম্যের অভাব ঘটেছে। গোবিন্দদাসের অনুকরণ সর্বস্ব ও কাব্যগুণে ন্যূন নিজের এতগুলি পদ সংকলিত করে রাধামোহন সুবিবেচনার কাজ করেননি। তবে তিনি সংকলিত পদগুলির ‘মহাভাবানুসারিণী’ নামক যে সংস্কৃত টীকা লিখেন তাতে পাণ্ডিত্যপূর্ণ রস বিশ্লেষণের পরিচয় রয়েছে। এতে পাঠকদের যথেষ্ট জ্ঞান লাভ হয়। যাহোক ‘পদামৃত সমুদ্রে রাধামোহনের প্রতিভা ও মননের স্বাক্ষর রয়েছে।

বৈষ্ণবদাসের ‘পদকল্পতরু’ :

গোকুলানন্দ সেন এই সুবৃহৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব পদ গ্রন্থের সংকলয়িতা। সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যে এটি এক অভিনব গ্রন্থ। ডঃ সুকুমার সেন এটিকে বৈষ্ণব পদাবলীর বেদগ্রন্থ নামে অভিহিত করেছেন—

“This work can be said to be the most representative and exhaustive anthology of Vaishnava Lyrics-a veritable Veda of Bengali Vaisnava religious poetry.”

গোকুলানন্দ সেন নিজে কবি ছিলেন। মুর্শিদাবাদ জেলার টেঞ্জ বৈদ্যপুর গ্রামে নিবাস ছিল। তিনি রাধামোহন ঠাকুরের মন্ত্রশিষ্য ছিলেন এবং বৈষ্ণবদাস নামে কবিতা লিখতেন। তিনি একজন সুদক্ষ কীর্তনীয়া ছিলেন। বিভিন্ন স্থানে ‘পদামৃত সমুদ্র’ অবলম্বনে কীর্তন করতেন। এবং এই গ্রন্থ অবলম্বনে এক বৃহৎ সংকলন গ্রন্থের ইচ্ছা জাগে। বহু স্থান ঘুরে অজস্র পরিশ্রমে তিনি বহু কবির পদ সংগ্রহ করেন। সেগুলি ‘পদকল্পতরু’তে সংকলিত। প্রথমে সংকলনটির নাম ‘গীতকল্পতরু’ নাম দিতে চান। পরে উক্ত নাম হয়।

আরো পড়ুন--  ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, শ্রীরূপ গোস্বামী

অনুমান পদকল্পতরু অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সংকলিত হয়। এই বৃহৎ সংকলনে ১৪০ জন পদকর্তার তিন হাজারের বেশি পদ সংকলিত হয়েছে। সংকলনটি চারটি শাখায় বিন্যস্ত। প্রথম শাখায় ১১টি পল্লব (অধ্যায়), দ্বিতীয় শাখায় ২৪টি অধ্যায়, তৃতীয় শাখায় ৩১টি অধ্যায় ও চতুর্থ শাখায় ৩৬টি অধ্যায় আছে। এতে কোনো টীকা নেই। কিন্তু বৈষ্ণব রসশাস্ত্র থেকে প্রবেশক শ্লোক সংযোজিত হয়েছে। এর ফলে পদবিন্যাস পদ্ধতির ভাবগত বৈশিষ্ট্য পাঠকের নিকট সহজে বোধগম্য হয়ে ওঠে।

পদকল্পতরুতে গোবিন্দদাসের ৪০৬টি পদ, চণ্ডীদাসের (বড়ু চণ্ডীদাস সহ) ১১৮টি পদ, জ্ঞানদাসের ১৮৬টি পদ, বলরাম দাসের ১৩৬টি পদ, বিদ্যাপতির ১৬৩টি পদ, দীনবন্ধু দাসের ৯৯টি পদ, রাধামোহনের ১৮২টি পদ রয়েছে। কবির স্বরচিত ২৬টি পদ আছে। গোকুলানন্দের বৈষ্ণববিনয় ও ভক্তি প্রগাঢ় ছিল। কবি হিসেবে নিজের রচনা সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি জানতেন অন্যান্য পদকর্তাদের থেকে তাঁর রচনার কাব্যগুণ তেমন নেই। তাই তিনি নিজের মাত্র কয়েকটি পদ সংযোজিত করেন। যাহোক, গোকুলানন্দ সেন (বৈষ্ণব দাস) বৈষ্ণব কবিকে বিস্মৃতির করাল গ্রাস থেকে উদ্ধার করেছেন। তাঁর এই ‘পদকল্পতরু’ সংকলন গ্রন্থের সাহায্যে সমগ্র বৈষ্ণব সাধনার তত্ত্বগত ও শিল্পসাধনার একটি পরিচয় লাভ করা যায়। এজন্য গোকুলানন্দ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

অন্যান্য সংকলন গ্রন্থ :

অষ্টাদশ শতাব্দীতে গৌরসুন্দরদাস ‘কীর্তনানন্দ’ শীর্ষক পদসংকলনে অনেক নতুন পদকর্তাকে স্থান দেন। ৬০ জন কবির প্রায় সাড়ে ছয়শত পদ এতে সংকলিত। গোকুলানন্দ সেনের সমসাময়িক ছিলেন গৌরসুন্দর। গৌরসুন্দর নিজেও পদ রচনা করতেন।

দীনবন্ধু দাস অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ৪০ জন কবির প্রায় পাঁচশত পদ নিয়ে ‘সংকীর্তনামৃত‘ সংকলন করেন। এতে তাঁর নিজের রচনা অর্ধেক কবিতা স্থান পেয়েছে। এটা যুক্তিসঙ্গত হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় বাঙালির প্রাণলোকের কবি চণ্ডীদাস সম্পূর্ণ বান পড়েছেন। যে চণ্ডীদাস বাঙালির অস্থিমেদমজ্জা রক্তের সঙ্গে মিশে আছেন, তাঁকে বর্জন করার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। পণ্ডিতদের মতে তিনি চণ্ডীদাসের অনুকরণে কবিতা লিখতেন। বোধ হয় সেজন্য উত্তমর্ণের নাম ও পদ চেপে গেছেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কমলাকান্ত দাসের ‘পদরত্নাকর‘, নিমানন্দদাসের ‘পদরসসার’, গৌরমোহন দাসের ‘পদকল্পলতিকা‘ শীর্ষক সংকলন গ্রন্থগুলি পুঁথি আশ্রয়ী। এছাড়া অনেক সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘পদকল্পলতিকা’ বটতলা থেকে ছাপা হয়। গ্রামাঞ্চলে এটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। চুঁচুড়ার অক্ষয়চন্দ্র সরকারের ‘প্রাচীন কবিতা সংগ্রহ‘, জগদ্বন্ধু ভদ্রের ‘গৌরপদতরঙ্গিণী‘ এবং রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের ‘পদরত্নাবলী‘ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বিশেষভাবে গৌরপদতরঙ্গিণীর ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। এতে দেড় হাজার গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ সংকলিত। মহাপ্রভু চৈতন্যের লীলাবৈচিত্র্য কবিদের চোখে কিরূপে প্রতিভাত হয়েছে তার একটা সামগ্রিক পরিচিত রয়েছে এই সংকলনে। জগদ্বন্ধু ভদ্র সেদিক থেকে বাংলা সাহিত্যের মহা উপকার করেছেন।

বৈষ্ণবমহন্ত বাবা আউল মনোহর দাসের প্রায় পনের হাজার পদের ‘পদসমুদ্র‘ শীর্ষক এক সংকলন গ্রন্থের কথা বলতে হয়। বৈষ্ণবভক্ত ও সাহিত্য রসিক হুগলির বদনগঞ্জ নিবাসী হারাধন দত্ত ভক্তনিধির কাছে এটি ছিল। এই বিরাট পুঁথি তিনি মুদ্রিত করেননি, কাউকে দেখতে দেননি। এই পুঁথির কথা শুনে অনেক আলোচনা হয়েছে। হারাধন ভক্তনিধির বক্তব্য ছিল পুঁথিটি খণ্ডিত। তাই তিনি সেটিকে লোকসমাজে আনেননি। যাহোক, হারাধন ভক্তনিধির গুপ্ত কক্ষ থেকে সেই নিধি হারিয়ে গেছে। এ সম্পর্কে, ড: অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য—

“যে মাছ ধরা পড়ে নাই, অথবা জাল ছিঁড়িয়া পলাইয়াছে, তাহার আকার আয়তন লইয়া গবেষণা নিষ্ফল’। 

‘শনিবারের চিঠি’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ও সুলেখক সজনীকান্ত দাসের নিকট এক বৈষ্ণব পদ সংকলন ছিল। এতে বহু অজ্ঞাতনামা কবির পদ স্থান পেয়েছে এবং প্রতি পৃষ্ঠায় সনের উল্লেখ আছে। এটি পুঁথির আকারে লেখা নয়, ছাপা পুস্তকের মতো। সনের উল্লেখ ও লিপির পরিচয়ে একে প্রাচীন সংগ্রহ বলা যাবে কিনা সন্দেহ। 

আরো পড়ুন--  কবি জ্ঞানদাস, 16শ শতকের কবি

বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রাজ্ঞ ও রসিক সতীশচন্দ্র রায়ের ‘অপ্রকাশিত ‘পদরত্নাবলী‘ সংকলন গ্রন্থ এক উল্লেখযোগ্য সংকলন। এতে ছয়শতের অধিক পদ সংকলিত। অনেক অপ্রকাশিত পদ ও অজ্ঞাত কবির পরিচয় আবিষ্কার করে তিনি তীক্ষ্ণ ধীশক্তি, পাণ্ডিত্য ও গবেষণার পরিচয় দিয়েছেন। 

সবশেষে গোপাল দাসের ‘শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ রসকল্পবল্লী‘ তাঁর পুত্র পীতাম্বর দাসের ‘রসমঞ্জুরী‘, মুকুন্দদাসের ‘সিদ্ধান্তচন্দ্রোদয়‘, চন্দ্রশেখর ও শশিশেখরের ‘নায়িকা রত্নমালা‘ উল্লেখযোগ্য। যদিও এগুলি ঠিক সংকলন গ্রন্থ নয়। তবে ধর্মতত্ত্ব ও রসতত্ত্বের ব্যাখ্যায় বৈষ্ণব পদাবলীর অনেক পদের উল্লেখ রয়েছে সেগুলি অন্য কোনো সংকলনে গৃহীত হয়নি। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য এগুলির মূল্য রয়েছে। 

শেষের কথা

অষ্টাদশ শতাব্দী মূলত বৈষ্ণবপদ সংকলনের যুগ। পঞ্চদশ-ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে তিনশ বছর ধরে যত বৈষ্ণব পদ রচিত হয় তারই উৎকৃষ্ট কবিতা নিয়ে সংকলন গ্রন্থ রচিত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কেউ কেউ বৈষ্ণবপদ রচনা করলেও সেগুলি কাব্যিক গুণগত বিচারে তেমন মূল্যবান নয়।

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব পদাবলী রচনার ধারা ক্ষীণস্রোতে হলেও অব্যাহত ছিল। প্রেমদাস, গোকুলানন্দ, চন্দ্রশেখর ও শশিশেখর, আকিঞ্চন দাস, রাধানাথ দাস, বিশ্বস্তর দাস, পীতাম্বর মিত্র ও জনমেজয় মিত্র পুরাতন রীতির অনুসরণে বৈষ্ণব পদ লিখেছেন। এঁদের কিছু কিছু পদ মোটামুটি রসসৌকর্য লাভ করেছে। তবে বেশির ভাগ অক্ষম নকল মাত্র তেমন কিছু কাব্যকৃতিত্ব নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মধুসূদন ‘রাধাবিরহ’ অবলম্বনে ‘ব্রজাঙ্গনা‘ লিখেন। সেখানে অপ্রাকৃত বৈষ্ণব ভাবুকতা অপেক্ষা প্রাকৃত জীবন রসেরই প্রাধান্য। মধুসূদনের রাধা অনেকটা মিসেস রাধা হয়ে উঠেছেন। রবীন্দ্রনাথ ব্রজবুলি ভাষার অনুসরণে ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী‘ রচনা করেন। রজনীকান্ত সেনও নিজের অনেকগুলি বৈষ্ণবপদ ‘পদচিন্তা মণিমালা‘ শীর্ষক সংকলনে প্রকাশ করেন। ধীরে ধীরে বৈষ্ণব পদ রচনার রীতি বিলুপ্ত হয়ে গেল পাশ্চাত্য শিক্ষা দীক্ষার প্রভাবে। অপ্রাকৃত জীবনলীলা নয়, মর্ত্যজীবন লীলার সুখদুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা বড় হয়ে উঠল সমাজে ও সাহিত্যে। কিন্তু গত চারশ বছর ধরে বৈষ্ণব সাহিত্যের যে ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছিল তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি। নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বৈষ্ণব সাহিত্যের চর্চা এখনো অব্যাহত আছে। তার সমাদর ও গুণগ্রাহিতা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!