Menu

কপালকুণ্ডলা 1866, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, উপন্যাস

কপালকুণ্ডলা 1866 : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় উপন্যাস কপালকুণ্ডলা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত টীকা সংযোজিত হলো।

প্রকৃতিপালিকা কোনো নারীকে সামাজিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করা সম্ভব কিনা – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বোধহয় প্রকৃতি মধ্যে বিচরণশীলা, কাপালিক প্রতিপালিতা কপালকুণ্ডলাকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন।

কপালকুণ্ডলা 1866, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, উপন্যাস


সূচনা

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রোমান্সধর্মী ঐতিহাসিক উপন্যাস। প্রকৃতি-দুহিতা ‘বনোন্মওা’ এক নারী বাস্তব সমাজ জীবনে প্রবেশ করে বাস্তবের সংঘাতে কিভাবে আবার প্রকৃতির কোলে ফিরে যায় – ইতিহাস ও রোমান্সের মিশ্রণে সেই কাহিনী আলোচ্য উপন্যাস এর বিষয়বস্তু। 

নামকরণ

‘কপালকুণ্ডলা ’ নামটি সংস্কৃত নাট্যকর ভবভূতির ‘মালতীমাধব’ নাটক থেকে সংগৃহীত। কারণ বঙ্কিমচন্দ্রের আলোচ্য উপন্যাসের কাপালিক ‘মালতিমাধব ’ নাটকের কাপালিকের দ্বিতীয় প্রতিরূপ।

পাশ্চাত্য প্রভাব

আকৃতি ও প্রকৃতিতে ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাস পাশ্চাত্য রোমান্সেরই বাংলা সংস্করণ। কেননা আলোচ্য উপন্যাসের অনেকগুলি পরিচ্ছেদের শুরুতে সাদৃশ্য দেখাতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র শেক্সপিয়ার, বায়রন, মেকলে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস এর রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যেমন– প্রথম খন্ডের প্রথম পরিচ্ছেদের (সাগরসঙ্গমে)  শেক্সপিয়ারের ‘ Comedy of Errors থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন — “ Floating Straight obedient to the Stream.”

আরো পড়ুন--  শনিবারের চিঠি 1924

খণ্ড, পরিচ্ছেদ, শিরোনাম

‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাস চারটি একখন্ডে একত্রিশটি  পরিচ্ছেদে বিভক্ত। খন্ডগুলির কোন নাম নেই অথচ পরিচ্ছেদগুলি শিরোনাম সম্বলিত। যেমন, দ্বিতীয় খন্ড প্রথম পরিচ্ছেদের শিরোনাম– ‘রাজপথে’, তৃতীয় খন্ড দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শিরোনাম — ‘পথান্তরে’ প্রভূতি। 

চরিত্র

‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রগুলি হল — কপালকুণ্ডলা, লুৎফ-উন্নিসা (মতিবিবি), নবকুমার ও কাপালিক। এছাড়া গৌণ চরিত্রগুলি যথাক্রমে শ্যামাসুন্দরী, মেহেরউন্নিসা, পেষমন, সেলিম, অধিকারী ইত্যাদি। 

আলোচ্য উপন্যাসে ‘কপালকুণ্ডলা’ প্রণয়-সংস্কার বরজিতা, ‘মেহের’ প্রণয় শালিনী, ‘শ্যামা’ প্রণয়বুভুক্ষ হয়েও প্রণয়-বঞ্চিতা এবং ‘লুৎফ-উন্নিসা’ ভোগসর্বস্ব কামনার প্রদীপ্ত শিখা। এই চারটি চরিত্র যেন নারী প্রকৃতির বিচিত্রার  চারটি রূপ। 

চন্দ্রশেখর উপন্যাসের সঙ্গে সাদৃশ্য

‘চন্দ্রশেখর’ যেমন ‘গঙ্গা প্রবাহীন কাহিনী’ তেমনই ‘কপালকুণ্ডলা’ ‘নিশীথ রাত্রির কাব্য’। কেননা ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের বেশিরভাগ ঘটনাগুলি ঘটেছে রাত্রিতে রহস্যময় আলো-আঁধারি পরিবেশে। ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে যেমন জ্যোতিষ গণনা, স্বপ্ন, নরক প্রভূতি অতি প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে তেমনই ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে ‘ভৈরবী দর্শন’ প্রভুতি অলৌকিক উপাদানের প্রভাব বর্তমান। 

বিশেষত্ব

[ক] বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে প্রকৃতি বিচিত্র রঙ্গিনী, অঘটন-ঘটনা-পটীয়সী। যেমন –‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে প্রকৃতি মহাপ্রকৃতি পরাশক্তির প্রতীক, প্রকৃতি যেন দূরচারিণী মৃগতৃষ্ণিকা। 

[খ] ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে দুটি স্বপ্ন-বৃত্তান্ত আছে– একটি কাপালিকের স্বপ্ন আর একটি কপালকুণ্ডলার স্বপ্ন। এক বিশিষ্ট সমালোচক‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাস সম্পর্কে বলেছেন – “কপালকুণ্ডলাভাবনায় কাব্য, প্রকাশভঙ্গিতে নাটক আর  জীবন-জিজ্ঞাসায় উপন্যাস। কাব্য নাটক আর উপন্যাসের এমন সার্থক মিলন বাংলা সাহিত্যে কম ঘটেছে।”

আরো পড়ুন--  অন্নদামঙ্গল ১৭৫১ খ্রি.

[গ] বাক্যগত ঘটনাগত শ্লেষ (Irony) -এর মাধ্যমে ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে যে নাটকীয় ভাবমণ্ডল সৃষ্টি করা হয়েছে, তাও যথেষ্ট তাৎপর্যবহ। যেমন, অধিকারী কপালকুণ্ডলাকে বলেছেন— ‘পতি শ্মাশানে গেলে তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে যাইতে হইবে।’

[ঘ] ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে দুটি বিশিষ্ট ঘটনার মধ্য দিয়ে নিয়তির কর্মরেখা ফোটানো হয়েছে। যেমন – কপালকুণ্ডলা -অধিকারী -নবকুমার -কাপালিক প্রসঙ্গ এবং মতিবিবি -নবকুমার প্রসঙ্গ। 

[ঙ] কপালকুণ্ডলার পরিকল্পনা, কাহিনীর নির্মাণ কৌশল, ভাবের ঐক্য, কাব্যধর্ম, নাটকীয় গুন, রোমান্সের অভিনবত্ব, প্রকৃতি চিন্তা প্রভূতি বঙ্কিম প্রতিভার আনন্দ স্ফূর্তি। এইসব গুণেই ‘কপালকুণ্ডলা’ অভিনব ও দ্বিতীয়-রহিত।

বৈশিষ্ট্য

(১) সমগ্র উপন্যাসটি চারটি খণ্ডে ও বিভিন্ন পরিচ্ছেদে বিভক্ত। নবকুমার-কপালকুণ্ডলার মূল ঘটনা ছাড়া আছে, শ্যামা এবং মতিবিবির প্রসঙ্গ। মতিবিবি ‘পদ্মাবতী’ এবং ‘লুৎফাউন্নিসা’ নামে একই অঙ্গে দুই রূপে প্রকাশিত হয়েছে। এই চরিত্র এ উপন্যাসের শ্রেষ্ঠতম অবদান।

(২) উপন্যাসের পটভূমি স্থির নয়, গতিশীল। সাগরসঙ্গমে অরণ্যভূমি থেকে শুরু করে সপ্তগ্রাম এমন কি সুদূর মুঘল-শাসিত দিল্লী পর্যন্ত এর কাহিনী প্রসারিত হয়েছে। কাহিনীকে ইতিহাসের আবহে পূর্ণ করে রোমান্সের চমকপ্রদ ভাব-গম্ভীর পরিবেশ-সৃষ্টি করার বঙ্কিমী-বৈশিষ্ট্য এখানে দেখা যায়।

আরো পড়ুন--  ইউসুফ জোলেখা কাব্য, শাহ মুহম্মদ সগীর

(৩) উপন্যাসটির গঠনাকৃতি নাটকের মতো বিভিন্ন পর্বে বিন্যস্ত হয়েছে। কাহিনীটি চতুর্থাঙ্ক নাটকের মতই পরিবেশিত। প্রতিটি ঘটনা সহজ, সংক্ষেপ এবং গতিশীল। একটি বিয়োগান্ত গ্রীক নাটকের আকৃতিতে প্রতিটি পরিচ্ছেদ সজ্জিত, প্রতিটি বিন্যাস পরিচ্ছন্ন, চরিত্রসমূহের দ্বন্দ্ব-আবেগে কাহিনী হয়ে উঠেছে প্রাণময়।

আবার নাটকের মধ্যে ‘dramatic foreshadowing’ (‘নাটকীয় পূর্বাভাস’) থাকে। এখানেও কপালকুণ্ডলার কালীপ্রতিমার পদতলে বিল্বপত্র দান ও বিচ্যুতির ঘটনা নায়িকার জীবনে দুর্ভাগ্য ও বিষাদান্ত পরিণতিকে নির্দেশ করে।

(৪) উপন্যাসে পরিচ্ছেদের সূচনায় বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি পাঠককে সম্ভাব্য ঘটনা সম্পর্কে সচেতন করে।

(৫) কবি-কল্পনার মূর্ত ব্যঞ্জনায়, পরিণতিতে ‘কপালকুণ্ডলা’র ভাব-রূপটি বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয়। W. Frazer মন্তব্য করেছিলেন: “Outside in ‘Marriage-be-Loti’ there is nothing comparable to the ‘Kapalkundala’ in the history of Western Fiction.” (Literary History of India, 1898)।

কপালকুণ্ডলা 1866 কপালকুণ্ডলা 1866 কপালকুণ্ডলা 1866 কপালকুণ্ডলা 1866


আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আরো টীকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!