Menu

 কাশীদাসী মহাভারত 

 কাশীদাসী মহাভারত : সংস্কৃত ভাষায় রচিত মহাভারত মহাকাব্যের বাংলায় অনুবাদ করার প্রথম সফল চেষ্টা লক্ষ করা যায় কাশিরাম দাসের কাব্যে অর্থাৎ ‘ভারত পাঁচালি’তে।

 কাশীদাসী মহাভারত 

জীবনী

কাশীরামের  নিজের দেওয়া তথ্য এবং অন্যান্য তথ্যাদি থেকে তার ব্যক্তি পরিচয় জানা যায়। কাশীরাম দাস এর জন্ম বর্ধমানের ইন্দ্রানী পরগনার অন্তর্গত সিঙ্গি গ্রামে, কায়স্থ বংশে। তার পিতার নাম কমলাকান্ত। সপ্তদশ শতাব্দীতে রামায়ণ মহাভারত ও ভাগবতের যে সমস্ত ভাবানুবাদ হয়েছিল তার মধ্য কাশীদাসই শ্রেষ্ঠ অনুবাদ। তাই কাশীরাম সম্বন্ধে মধুসূদন দত্ত জানিয়েছেন —

মহাভারতের কথা অমৃত সমান। 
হে কাশী,কবীশ দলে তুমি পুণ্যবান।। 

আবির্ভাবের সময়

কবির আবির্ভাব কাল ও কোভিদ রচনাকাল নিয়েও মতভেদ আছে। কবির ছোট ভাই গদাধর দাস ‘ জগৎমঙ্গল ’ রচনা করেছিলেন ১৬৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে। এই কাব্যে কাশীরামের উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং কাশীরামের  কাব্য ‘ জগৎমঙ্গল ’ এর পূর্বে রচিত হয়েছে। সাহিত্য পরিষদের রক্ষিত কাশীরামের একটি পুথিতে পাওয়া যায় কাশীরাম এর কাব্য ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে রচিত। কবির পরিবারের প্রায় সকলেই কবি প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। সমালোচকদের মতে, কবির তিরোধানের পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র ও ভ্রাতুষ্পুএ দুজনে মিলে কাব্যটি সমাপ্ত করেন। 

তাৎপর্য

অনুবাদের ক্ষেত্রে কাশীরাম হুবহু অনুবাত করেননি। তিনি কৃত্তিবাসের মত মর্মানুবাদ করেছেন। সাধারণ মানুষের কথা ভেবে রসতৃষ্ণা চরিতার্থ করবার জন্য তাদের উপযোগী করে কবি তার মহাভারতের রচনা করেছেন। কাশীরামের মহাভারত রচনার উদ্দেশ্যেও ধর্মমূলক। কাব্য তিনি উল্লেখ করেছেন :

যেই বাঞ্ছা করি লোক শুনয়ে ভারত। 
গোবিন্দ করেন পূর্ণ তার মনোরথ।। 

কাশীরাম পন্ডিত কবি ছিলেন। কাশীরাম ব্যাসদেবের মূল সংস্কৃত মহাভারতের কিছু অংশ গ্রহণ বর্জন করেছেন। সংস্কৃত মহাভারত ছাড়াও নানাপুরাণ ও উপপুরান থেকে কাশীরাম তার কাব্য কাহিনী উপাদান সংগ্রহ করেছেন। যেমন –শ্রীবৎস চিন্তার উপাখ্যান, পারিজাত  হরণ,সত্যভামা তুলাব্রত, রাজসূয় যজ্ঞে বিভীষণের আগমন প্রভৃতি ঘটনা ব্যাসদেবের মহাভারতে নেই। 

আরো পড়ুন--  উজ্জ্বলনীলমণি, শ্রীরূপ গোস্বামী

কাশীরাম যে সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন, তার বড় প্রমাণ বাসুদেবের মহাভারতের সঙ্গে যথেষ্ট ভাষাগত সাদৃশ্য তার কাব্যের। সংস্কৃত ভালো না জানলে কাশীরাম এভাবে বাসদেবের মহাভারতের স্বচ্ছ অনুবাদ করতে পারতেন না। যেমন, 

    

বৈয়াসকী মহাভারত

অর্থনামার্জনে দু:খং বর্ধনে রক্ষণে তথা। 
তেষাং হি বৈরিনো জ্ঞাতি বহিু তস্কর পার্থিব :।।

কাশীরামের মহাভারত :

উপার্জনে যত কষ্ট ততেক পালনে। 
ব্যয়ে হয় যত দু:খ ক্ষয়েতে দ্বিগুণে।।
অর্থ যার থাকে তার সদা ভীম মন।
তার বৈরি রাজা- অগ্নি - চোর- বন্ধুজন।।

কাশীদাসী মহাভারতের মূল থেকে বিচ্যুতি সবচেয়ে বেশি অশ্বমেধ পর্বে।যেমন মূলের মিল রাজার কাহিনী কাশিদাসে নীলদ্ধজ জনা উপাখ্যানে  পরিণত হয়েছে। মধুসূদন তার ‘বীরাঙ্গনা  কাব্যে’ এই কাহিনী অনুসরণ করেছেন। সভা পর্বের হংসধ্বজ রাজার প্রসঙ্গ সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। 

আরো পড়ুন--  সমাচার চন্দ্রিকা 1822

কাশীরামের মহাভারতের চরিত্রগুলি বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, জীবনচর্চায় ধ্যান-ধারণায় মিশে গেছে। তাই ভীম ও অর্জুন মূল মহাভারতের মতো ক্ষাএতেজে দীপ্ত নয়। দ্রৌপদী তাই অনেকটাই কোমলমতি বাঙালি বধূ। সভা পর্বে দ্রৌপদী ও হিড়িম্বার যে কলহ বর্ণিত হয়েছে, তা শব্দ তার শতাব্দীর বাঙালি সমাজের দুই সতীনের কলহ স্মরণ করিয়ে দেয়। সভাস্থলে দ্রৌপদীর সঙ্গে ভীম পত্নী হিড়িম্বা আসন গ্রহণ করলে রুষ্টা দ্রৌপদী সপত্নীসুলভ ঈর্ষা বশে হিড়িম্বা কে কটু ভাষায় গালি দেন :

 

কৃষ্ণা বলে, নহে দূর খলের প্রকৃতি। 
আপনি প্রকাশ হয় যার যেই রীতি।।
কি আহার কি বিচার কোথায় শয়ন।
কোথায় থাকিস তোর না জানি কারণ ।।

তার উওরে হিড়িম্বা দ্রৌপদীকে  শাসিয়ে বলে :

কুপিল হিড়িম্বা দ্রৌপদীর বাক্যজালে। 
দুই চক্ষু রক্তবর্ণ কৃষ্ণা পতি বলে।।

       

কাশীদাসের মহাভারত আদ্যন্ত সুন্দর ও জীবন্ত। বর্ণগুলি সহজ ও স্বাভাবিক। যেমন, আদি পর্বে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নপর সৈন্যদের চিত্র :

যেদিকে পারিল যেতে সে গেল সেদিকে।
পলায় পশ্চিমবাসী রাজা পূর্ব্বদিকে।।
উওরের রাজাগন দক্ষিণেতে গেল।
পথাপথ নাহি জ্ঞান যে দিক পাইল।।

     

আরো পড়ুন--  কবি জয়ানন্দের পরিচয় | চৈতন্যমঙ্গল কাব্যের পরিচয়

শিল্পরীতিতে কাশীরাম দাসের স্বকীয়তার পরিচয় তার কাব্য রয়েছে। অর্জুনের লক্ষ্যভেদ প্রসঙ্গে কাশিরাম অর্জুনের ক্ষাএজনোচিত চরিত্র ধর্ম ও শারীরিক সৌন্দর্য অপূর্ব মন্ডনকলাই মন্ডিত করেছেন :

দেব দ্বিজ মনসিজ জিনিয়া মুরতি। 
পদ্মপএ যুগ্মনেএ পরশয়ে শ্রুতি।।

          

 বাঙালি সুদীর্ঘকাল ধরে পান করে আসছে কাশীদাসী কাব্যামৃত। কাশীদাসী মহাভারতে এমন একটা বিশুদ্ধতা ও স্নিগ্ধতা আছে, যা ভর্তি মিস্ত্রিত সহজ ধর্মবোধ সংযোগে আমাদের জাতীয় মনটিকে তৈরি করেছে, জাতীয় মনের সঙ্গে সঙ্গে  আবার এ মহাভারতও গড়ে উঠেছে। তাই এই কাব্যকে লোক কাব্য বলা চলে। সুতরাং এসব দিক থেকে কাশীরামের মহাভারত মহাভারতের অনুবাদ শাখার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। 

  

দীনেশচন্দ্র সেন তাই কাশীদাসী মহাভারতের প্রভাবের দিক থেকে যথার্থই বলেছেন, “ বঙ্গ দেশে এই মহাভারতসমুদ্র হইতে এখনও ‘ শ্রীকৃষ্ণচরিত্র ’, ‘ রৈবতক’, ‘ কুরুক্ষেত্র ’,‘ চিত্রাঙ্গদা ’ প্রভৃতি অসংখ্য বুদবুদ উক্ষিত হইয়া প্রাচীন ভাবের অফুরন্ত আবেগ ঞ্জাপন করিতেছে। এই কাব্য লইয়া হিন্দুস্থানের ভাবী অধ্যায় আর কত করবি ও বীর চিত্রকর যশস্বী হইবেন,কে বলিতে পারে? ”


মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে টীকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!