চরকসংহিতা : আয়ুর্বেদশাস্ত্র বা চিকিৎসাশাস্ত্র হিসাবে সংস্কৃত ভাষায় রচিত চরকসংহিতা অন্যতম ও প্রাচীনতম গ্রন্থ।
এই গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত আলোচনা দেওয়া হলো।
চরকসংহিতা
সূচনা
বর্তমানে যে আকারে ‘চরকসংহিতা’ গ্রন্থটি পাওয়া যায় তার প্রকৃত রচয়িতা হলেন মহর্ষি আত্রেয়ের অন্যতম শিষ্য অগ্নিবেশ। অথর্ববেদের পর থেকে উপনিষদ যুগের শেষ পর্যন্ত ‘অগ্নিবেশতন্ত্র’-ই আয়ুর্বেদশাস্ত্র শিক্ষার প্রধান গ্রন্থ ছিল। কালের করাল গ্রাসে এবং দীর্ঘকাল উপযুক্ত চর্চার অভাবে অগ্নিবেশ সংহিতার বহুলাংশ বিনষ্ট হয়।
পরিচিতি
পূর্ণাঙ্গ আয়ুর্বেদ চর্চার অভাবে সমাজে অকাল মৃত্যু, জরা ও ব্যাধির প্রকোপ দেখে অহিপতি ভগবান শেষনাগ চরকরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে লুপ্তপ্রায় অগ্নিবেশতন্ত্রের সংস্কার সাধন করেন। চরকের নামানুসারে সেই গ্রন্থ ‘চরকসংহিতা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
প্রকৃত রচয়িতা
পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে, উপলভ্যমান চরকসংহিতা কোন একক ব্যক্তির রচনা নয়। এই অনুমান অমূলক নয়। কারণ চরকসংহিতার শেষে উল্লিখিত হয়েছে যে, এই গ্রন্থটি অগ্নিবেশ কর্তৃক রচিত, চরক কর্তৃক প্রতি-সংস্কৃত এবং মহাত্মা দুঢ়বলের দ্বারা পরিপুরিত। চরকসংহিতার চিকিৎসাস্থানের ত্রিংশ অধ্যায়েও বলা হয়েছে-
"অস্মিন, সপ্তদশাধ্যায়াঃ কল্পাঃ সিদ্ধয় এব চ।
নাসাদ্যন্তে অগ্নিবেশস্য তন্ত্রে চরকপ্রতিসংস্কৃতে।।
তানেতান্ কাপিলবলো শেষান্ দৃঢ়বলোহকরোৎ।
তন্ত্রস্যাস্য যথার্থস্য পুরণার্থং যথাতথম্ ॥" (চরকসংহিতা, চিকিৎসাস্থান)
অর্থাৎ চরকের দ্বারা সংস্কৃত অগ্নিবেশসংহিতার চিকিৎসাস্থানের শেষ সপ্তদশ অধ্যায় এবং সম্পূর্ণ কল্পস্থান ও সিদ্ধিস্থান বিনষ্ট হওয়ায় পরবর্তীকালে কপিলের পুত্র দৃঢ়বলের দ্বারা তা পরিপুরিত হয়। কাজেই চরকসংহিতার রচয়িতা অগ্নিবেশ, প্রতি-সংস্কর্তা চরক এবং পরিপূরক দৃঢ়বল।
গ্রন্থ পরিচিতি
চিকিৎসাশাস্ত্র হিসাবে চরকসংহিতা আজও সর্ববৃহৎ এবং সর্বতথাসমন্বিত। গ্রন্থটি আটটি স্থানে বিভক্ত –
(১) সূত্রস্থান,
(২) নিদানস্থান,
(৩) বিমানস্থান,
(৪) শারীরস্থান,
(৫) ইন্দ্রিয়স্থান,
(৬) চিকিৎসিতস্থান
(৭) কল্পস্থান ও
(৮) সিদ্ধিস্থান। এ
গুলির প্রতিটি আবার বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত। মোট অধ্যায়ের সংখ্যা একশত কুড়ি।
বিষয়বস্তু
[১] আয়ুর্বেদের লক্ষণ ও প্রয়োজন, শারীরিক ও মানসিক দোষসমূহের বিবরণ, চিকিৎসার্হ বৈদ্যের লক্ষণ, শারীরিক স্বাভাবিক ক্রিয়া-দমনে বিভিন্ন ব্যাধির উৎপত্তির বিবরণ সূত্রস্থানে সন্নিবিষ্ট হয়েছে।
[২] নিদানস্থানে আছে ব্যাধির ভেদ, পর্যায় ও বিভিন্ন ব্যাধির লক্ষণ।
[৩] কটু, অম্লাদি রসের কার্যকারিতা, বিভিন্ন রোগের মূলে তাদের ভূমিকার কথা আলোচিত হয়েছে বিমানস্থানে
[৪] শারীরস্থানটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল – ধাতুভেদে পুরুষের ভেদ, শরীরের গঠনানুসারে রোগের ভেদ নির্ণয়।
[৫] ইন্দ্রিয়স্থানে আছে ব্যাধির উদ্ভবে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের ভূমিকার বিশদ আলোচনা।
[৬] চরকসংহিতার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল চিকিৎসাস্থান নামক অংশটি। এখানে বিভিন্ন রোগের কারণ ও তার প্রতিকারের উপায় আলোচিত হয়েছে। বহু দূরারোগ্য ব্যাধি যেমন, রাজযক্ষা, কর্কট প্রভৃতি চিকিৎসার পদ্ধতিও এখানে নির্দিষ্ট হয়েছে।
[৭] কল্পস্থানে আছে দ্রব্যগুণ বিচার ও বিভিন্ন গাছ-গাছড়া থেকে ঔষধ প্রস্তুতের বিবরণ।
[৮] বিভিন্ন ব্যাধি থেকে সত্বর আরোগ্য লাভের উপায়, ঔষধের সেব্যাসেব্য বিচার প্রভৃতি নির্দিষ্ট হয়েছে সিদ্ধিস্থান নামক অংশে।
গুরুত্ব
নীরোগ দীর্ঘায়ু লাভের পক্ষে যা কিছু প্রয়োজন তার সবই চরকসংহিতায় আলোচিত হয়েছে। হিমালয়ের মত বিশাল ও মহাসমুদ্রের মত দূরধিগম্য এই গ্রন্থটিকে সর্ববিধ জ্ঞানের ভাণ্ডার বললেও অত্যুক্তি হয় না। শুধু চিকিৎসাগ্রন্থ হিসাবে নয়, মানুষের সার্বিক মানসিক উন্নতির জন্য যা কিছু জ্ঞানের প্রয়োজন তৎসমুদয় লিপিবদ্ধ হয়েছে চরকসংহিতায়।
রোগের উৎপত্তি নির্ণয়
ব্যাধিসমূহের উৎপত্তির আলোচনা প্রসঙ্গে চরকসংহিতায় বলা হয়েছে যে, মানুষের সর্ববিধ রোগের মূলে আছে বায়ু, পিত্ত ও কফের প্রভাব – “বায়ুঃ পিত্তং কফশ্চোক্তঃ শারীরো দোষসংগ্রহঃ।” চরক মানুষের সকল ব্যাধিকে আগ্নেয়, সৌম্য ও বায়ব ভেদে তিনটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছেন। তাঁর পূর্বসূরীরা যে রাজস ও তামসভেদে বাধিসমূহকে দু’টি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন তাও তিনি উল্লেখ করেছেন- “অতস্ত্রিবিধা ব্যাধয়ঃ প্রাদুর্ভবস্তি – আগ্নেয়া;, সৌম্যা বায়ব্যাশ্চ; দ্বিবিধাশ্চাপরে রাজসাঃ তামসাশ্চ।” চিকিৎস্থানে রাজ-যক্ষাকে একাদশ ব্যাধির সম্মেলন বলা হয়েছে।
চরকসংহিতার পরিপূরক মহাত্মা দৃঢ়বল উপসংহারে মন্তব্য করেছেন –
"চিকিৎসা বহ্নিবেশস্য স্বস্থাতুরহিতং প্রতি।
সদিহাস্তি তদন্যত্র যত্নেহাস্তি ন তৎ ক্বচিৎ।।" (সিদ্ধিস্থান)
অর্থাৎ সুস্থ ব্যক্তি ও রোগীর চিকিৎসা বিষয়ে অগ্নিবেশ চরকসংহিতায় যা বলেছেন তা অপরাপর চিকিৎসাশাস্ত্রে থাকতে পারে, কিন্তু, চরকসংহিতায় যা নেই তা অন্য কোথাও নেই।
টীকাকার
চবকসংহিতা যে এককালে বহুগুণ সমাদৃত হয়েছিল তার প্রমাণ এই গ্রন্থের উপর রচিত অসংখ্য টীকা। চরকসংহিতার টীকাকারদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন – চক্রপাণি দত্ত, শিবদাস, গঙ্গাধর, ঈশ্বর সেন, শ্রীকণ্ঠ, ঈশানদেব, জিনদাস, ব্রহ্মদেব, ইন্দুকর প্রমুখ।