Last Update : May 24, 2024
চর্যাপদ বা চর্যাগান কিংবা চর্যাগীতি হলো বাংলা ভাষার আদিতম নিদর্শন। এখন এই পদ বা গানগুলির রচনাকাল নিয়ে নানা ধোঁয়াশা থাকবে তা স্বাভাবিক। এই লেখায় চর্যাপদের রচনাকাল সম্বন্ধে সাধারণ কিছু কথা তুলে ধরা হয়েছে।
চর্যাপদের রচনাকাল বা চর্যাগীতির রচনাকাল
প্রাচীন বাংলাভাষার অদ্বিতীয় নিদর্শন চর্যাপদ শুধু ভাষা এবং ধর্মের রহস্যইসূচীভেদ্য নয়, তার রচনাকালও সংশয়ান্বিত। ভাষাতত্ত্বের দুই প্রতিনিধিস্থানীয় পণ্ডিত ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ সম্বন্ধে ছিলেন ভিন্ন মতাবলম্বী।
ড. সুনীতিকুমারের ও ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী মতে, চর্যাগুলি খ্রিস্টীয় ১০ম-১২শ শতকের মধ্যে রচিত। ড. শহীদুল্লাহ এবং পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, দোহা ও চর্যার রচনাকালকে আরো দু’শ বছর পিছিয়ে দিয়ে ৮ম-১২শ শতকের অন্তর্ভূক্ত করা উচিত।
রাহুল সংকৃত্যায়ন ‘পুরাতাত্ত্বিক নিবন্ধাবলী’ গ্রন্থে দেখাতে চেয়েছেন লুইপাদ এবং সরহপাদ দুজন প্রাচীন সিদ্ধাচার্য ধর্মপালের সমসাময়িক (৭৬৯-৮০৯ খ্রিস্টাব্দ); ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’র আলোচনায় ভুসুকু ও কাহ্নপাদকে ৮ম শতাব্দীর অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়াসী।
চর্যাপদগুলোর সংকলনের আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন যে, লুইপার ‘অভিসময়বিভঙ্গ’ গ্রন্থ রচনার সময়ে প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ আচার্য দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান সাহায্য করেছিলেন। কথিত আছে,৫৮ বছর বয়সে শ্রীজ্ঞান তিব্বত যান (অর্থাৎ ১০৩৮ খ্রিস্টাব্দ)। সেক্ষেত্রে লুইপাদ ১০ম শতাব্দীর নিকটবর্তী সময়ে আবির্ভূত হওয়া যুক্তিযুক্ত। তিব্বতী কিংবদন্তী অনুসারে লুইপাদ সিদ্ধাচার্যদের আদি গুরু। সুতরাং এই সূত্র অনুসারে চর্যা রচনার প্রাচীনতম সীমা ১০ম শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত মনে করা যেতে পারে।
ড. সুনীতিকুমার তার ‘The Origin and Development of Bengali Language’ নামক গ্রন্থে এবং ড.প্রবোধচন্দ্র বাগচী তাঁর ‘Dohakosa’ গ্রন্থে চর্যার রচনা সময় ১০ম-১২শ শতাব্দীর মধ্যে মনে করেছেন। কাহ্নপাদ-গোরক্ষনাথের আনুমানিক আবির্ভাবকাল ধরে ড. সুনীতিকুমারের সিদ্ধান্ত,চর্যাণ্ডলি ঐ ৯৫০ হতে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত। তাঁর মতে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার প্রথম স্তরের অন্তর্ভুক্ত;এর রচনাসীমা আনুমানিক ১৪শ শতকের শেষভাগ। চর্যার ভাষা এর অপেক্ষা দেড়শ বছর পূর্বের রচনা;অর্থাৎ ভাষাতত্ত্বের বিচারেও এর অনেক পদ ১২শ শতাব্দীতে রচিত বলে মনে হয়।
অন্যান্য যুক্তি
১. কাহ্নপাদ ও গোরক্ষনাথের আবির্ভাবের আনুমানিক কাল ধরে চর্যার রচনাকালের সীমা নির্ধারণ করা অসম্ভব নয়। কেননা পণ্ডিতাচার্য শ্রীকৃষ্ণপাদ রচিত ‘হেবজ্রপঞ্জিকা যোগরত্নমালা’ নামক একটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক গ্রন্থ পালবংশের শেষ রাজা গোবিন্দ পালের সময় (আনুমানিক ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে) রচিত হয়। সুনীতিকুমারের মতে, তিব্বতে একাধিক কাহ্নপাদের উল্লেখ সত্ত্বেও চর্যার কাহ্নপাদ এবং এই বৌদ্ধতন্ত্র গ্রন্থের পণ্ডিত আচার্য শ্রীকৃষ্ণপাদ অভিন্ন ব্যক্তি; কারণ চর্যার এক স্থলে কাহ্নপাদ ‘পণ্ডিতয়াচায়ে’ অর্থাৎ ‘পণ্ডিতাচার্য’ বলে উল্লেখিত হয়েছেন। কাহ্নপাদের কোন কোন টীকায় ‘কৃষ্ণচার্য’নামটিও পাওয়া যায়।
২. নাথ সাহিত্যে বা নাথ ধর্মের সাক্ষ্য-অনুযায়ী গোরক্ষনাথের শিষ্য হলেন জালন্ধর পাদ বা হাড়িপা এবং তাঁরই শিষ্য কানুপা বা কাহ্নপাদ।
৩. মারাঠী গ্রন্থ ‘জ্ঞানেশ্বরী’ (আনুমানিক ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ) হতে মনে হয়, উক্ত গ্রন্থের লেখক জ্ঞানদেব তাঁর অগ্রজ নিবৃত্তিনাথের কাছে দীক্ষালাভ করেন ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দে। নিবৃত্তিনাথের গুরু ছিলেন গেইনীনাথ বা গোয়নীনাথ (মতান্তরে জ্ঞানীনাথ)। এই গেইনীনাথের দীক্ষা গুরু হলেন গোরক্ষনাথ। তাঁর শিষ্য জালন্ধরি পাদ, তাঁরই শিষ্য কৃষ্ণপাদ বা কাহ্নপাদ। অতএব অনুমান হয় যে, কৃষ্ণপাদের আবির্ভাবকাল সম্ভবত ১২শ শতাব্দী।
এইসব তথ্য প্রকাশের ফলে চর্যাপদের রচনাকালকে স্থূলত ১০ম—১২শ শতাব্দীর মধ্যে স্থাপন করা যেতে পারে বলে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন।
সাহায্য : পার্থ চট্টোপাধ্যায়