Last Updated on December 30, 2021 by বাংলা গাইড
তুর্কি আক্রমণ । বাংলা সাহিত্যে তার প্রভাব
দ্বাদশ থেকে চতুর্দশ শতক—দেশের ইতিহাসে এক চরম সঙ্কটময় মুহূর্ত। এই সঙ্কটের কারণ প্রধানত ত্রিবিধ : রাজনৈতিক,ধর্মনৈতিক এবং সামাজিক।বলা বাহুল্য এদের কোনটাই পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন নয়,এক যোগে যুক্ত।
রাজনৈতিক পরিবর্তন
রাজনৈতিক সংকটের কারণ পর্যালোচনায় দেখা যায় মাত্র দশম থেকে দ্বাদশ শতক,এই দুশো বছরে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পটনা সংঘটিত হয়েছে। এই সময়ে পতন হয়েছে পালরাষ্ট্রের,ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠা ও প্রাধান্য পেয়েছে সেন-বর্মন রাষ্ট্র এবং সেন-রাজত্বের শেষ হয়েছে এক সময়,মুছে দিয়ে গেছে বাঙালির ইতিহাসে হিন্দু-আধিপত্যের গৌরবময় তিলকচিহ্ন। বস্তুতপক্ষে,এই সময়ই ইখতিয়ার–উদ্দীন মুহম্মদ-বিন-বখতিয়ার খিলজির নুদিয়া’ জয়ের অন্যতম ঘটমা ঘটে ঘটে। পশ্চিম সুন্দরবনে প্রাপ্ত ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দের একটি লিপিতে দেখা যায় খাড়ির পূর্বদিকে (সুন্দরবন) তিনি কোন এক স্থানীয় শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছেন। অথচ বিজয় সেন ওলক্ষ্মণ সেনের ইতিহাসে প্রদত্ত বিবরণ থেকে মনে হয়, খাড়ি-জেলা সেনরাজাদের রাজ্যভুক্ত ছিল। ডোম্মন পালের বিদ্রোহ স্পষ্টতই সেন-শাসনের অন্তর্নিহিত দুর্বলতার প্রমাণ। ফলে উত্তর ভারত জয় করার পর মুসলমান শক্তি ১২০২ অব্দে নদীয়া জয় করে নেওয়ার পর বঙ্গসস্কৃতির নকশা অনেকখানি পাল্টে যায়। বখতিয়ারের বরেন্দ্রভূমি জয়,বহরাম ইৎসিন জাফর খাঁর সপ্তগ্রাম-বিজয় (১২৯৮ খ্রি.),শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ-এর রাজত্বকালে পূর্ববঙ্গ বিজয় (১৩০২-২২ বঙ্গাব্দ),রুকনুদ্দিন বরবক শাহ–এর আমলে দক্ষিণবঙ্গ বিজয় (১৪৬৫ খ্রি.)প্রভৃতি ঘটনা প্রমাণ করে দেশের এক–একটি অংশে দীর্ঘ সময় ধরে প্রবল উত্তেজনা
লেগে ছিল।
লেগে ছিল।
“বহু শত বর্ষ ধরিয়া সুখে শান্তিতে বাস করার পর রাষ্ট্রীয়পরিবর্তন সুখের হয় নাই এবং সাম্যভাবে প্রতিষ্ঠার সময় লাগিয়াছিল (মধ্যযুগে বাঙ্গালা,অবতরণিকা,প্রথম দে’জ সংস্করণ, ২০০২,পৃষ্ঠা ২৬)—কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের ক্রান্তি কালের সময় Dark Age বা Barren Period দেখা যায়। ইউরোপে এধরনের ঘটনা ঘটেছিল ২৩৬ অব্দে ফ্রান্স,গল প্রভৃতি জাতির আক্রমণে হেলেনীয় সংস্কৃতির বিপর্যয়ে।
ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশেও এই জাতীয় অরাজক অবস্থার সূচনা হয়। রাজপুরুষ ও দাসদের কুটচক্রান্ত,জায়গীর–প্রার্থী রাজকর্মচারীদের আকস্মিক বিদ্রোহ,পাঠান,খিলজি,হাবশী সুলতানদের চন্ডনীতি,ইসলামী ধর্মান্ধতা ও রক্তাক্ত সংঘর্ষে সাধারণ বাঙালীর আতঙ্কে কূর্মবৃত্তি অবলম্বন,ভূম্যধিকার-প্রাপ্ত ব্যক্তিদের লোভাতুর ছবি ও পাপাচারনের নিরবচ্ছিন্ন ঘটনা সমগ্র দেশে এক অন্ধকার পরিবেশ সৃষ্টি করে। ‘মাৎসন্যায়’ প্রবল হয়ে ওঠে। মার্কস বর্ণিত প্রাক-ব্রিটিশ রাষ্ট্রীয় অবস্থা ছিল – when all were struggling against all’. স্বভাবতই এ অবস্থায় সাহিত্য-সৃষ্টি দুঃসাধ্য ছিল।
ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তন
ধর্মনীতিক সঙ্কটের কারণ প্রধানত দেশের অভ্যন্তরে নানামুখী সম্প্রদায়,বিশেষত বৌদ্ধদের হিন্দু রাজশক্তি ও রাজধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ। এ সম্পর্কে ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ বিষয়ক ছড়াটি উল্লেখযোগ্য একটি নিদর্শন,যেখানে ধর্ম স্বয়ং অন্যান্য দেবদেবীদের নিয়ে ‘হৈয়া যমনরূপী শিরে ধরে কাল টুপী হাতে ধরে তিরকস কামান।’ তার পরে ‘দেউল দেহারা ভাঙ্গে কাড়্যা ফিড়্যা খায় রঙ্গে পাখড় পাখড় আল্লা বোল।’ এই তীব্র বিদ্বেষের কারণ বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানে মগ্ন ‘দ্বিজশ্রেষ্ঠ’ ব্রাহ্মণদের বেদবিরোধী বৌদ্ধদের প্রতি দুর্বিচার ও অত্যাচার—‘ই বড় হইল অবিচার।’ ড. নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন,
‘এই যুগের একটি লিপিতেও এমন প্রমাণ নাই যেখানে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী কেহ বা কোন বৌদ্ধ বিহার বা সংঘ কোন প্রকার রাজানুগ্রহ লাভ করিতেছেন।’(“বাঙ্গালীর ইতিহাস‘)
সামাজিক বিকৃতি
আবার সমাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা যায় ধর্ম-কর্ম ও দেবালয়কে অশোভন যৌন-বিহার স্পর্শ করেছিল। “লক্ষ্মীশঙ্কাং প্রকৃতিসুভগাঃ কুর্বতে বাররামাঃ” বলে ধোয়ী দেবদাসীর যে উৎসাহজনক বর্ণনা ‘পবনদূত‘কাব্যে দিয়েছেন তা ছিল স্পষ্টতই রাজা ও ধর্মের অনুমতিপ্রাপ্ত। ‘বৃহধর্মপুরাণে’র পুরাণের পরোক্ষ-ইঙ্গিত অনুযায়ী দুর্গোৎসব উপলক্ষে শবরদের উৎসব পালিত হয়। তার অনুকরণে কুৎসিত নাগরিক বিকৃতি দেখা দেয়। ‘কালবিবেক’ গ্রন্থে এর সমর্থন পাওয়া যায়।
সুতারাং ধর্মের উদারতা ও কল্যাণময়তার কোনও উজ্জ্বল আদর্শ এই সময়ে কবি শিল্পীর কল্পনাকে জাগ্রত করে নি।
সাহায্য : পার্থ চট্টোপাধ্যায়