Menu

বিদ্যাপতির জীবন ইতিহাস, Best unique 7 points

Last Update : June 8, 2024

মৈথিল কোকিল বিদ্যাপতির জীবনের নানাদিক নিয়ে এই লেখাটি প্রস্তুত করা হয়েছে। বৈষ্ণব সাহিত্যের শিরোমণি বিদ্যাপতির ব্যক্তিগত জীবনের যতখানি তথ্য এখন জানা সম্ভব তা সংক্ষেপে এখানে উল্লিখিত হল।

বিদ্যাপতির জীবন ইতিহাস

শুরুর কথা


মিথিলার কবি হওয়া সত্ত্বেও বিদ্যাপতি বাঙালির জীবন ও সাধনার সঙ্গে গভীর আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ। বিদ্যাপতিকে বাঙালি পরম শ্রদ্ধা-সহকারে বরণ করে নিয়েছে। তাঁর কবিতাবলীর রসমাধুর্য উপভোগ করেছে, প্রচার করেছে ও বিচার-বিশ্লেষণ করেছে। সমালোচকের ভাষায় বাঙালি বিদ্যাপতির কবি খ্যাতিকে পবিত্র হোমাগ্নির মতো রক্ষা করেছে। বাংলাদেশে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বিদ্যাপতির পদাবলী বৈষ্ণব ও অবৈষ্ণব রসিক সমাজে যথেষ্ট প্রচার লাভ করে। ফলে বাঙালি ভুলে গিয়েছিল যে বিদ্যাপতি মিথিলার কবি।

পাশ্চাত্ত্য শিক্ষাদীক্ষার ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে প্রাচীন যুগের কবি ও কাব্য সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালি বিশেষভাবে কৌতূহলী হয়ে উঠেন। তখন থেকেই বিদ্যাপতি সম্পর্কে তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা শুরু হয়। অনেক প্রবন্ধ ও পুস্তিকায় বিদ্যাপতির জীবনী ও কবিপ্রতিভা সম্পর্কে বিশেষ আলোকপাতের প্রয়াস দেখা দেয়। রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রামগতি ন্যায়রত্ন, হরিমোহন চট্টোপাধ্যায়, মহেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও পুরাতত্ত্ববিদ জন বীমস্‌ বিদ্যাপতির জীবনী সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য পরিবেশন করেন।

রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় দ্বারাভাঙ্গা অঞ্চল পরিভ্রমণ করে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১২৮২ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠমাসে ‘বিদ্যাপতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে জানান যে, বিদ্যাপতি বাঙালি কবি নন। তিনি মিথিলার মধুবনী পরগনার অন্তর্গত বিসফী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর গ্রিয়ারসন সাহেব কর্মব্যপদেশে দ্বারভাঙ্গা পরিভ্রমণ করে মিথিলা থেকে বিদ্যাপতির কিছু পদ সংগ্রহ করে প্রবন্ধ লেখেন। এর ফলে শিক্ষিত বাঙালি সমাজে বিদ্যাপতি সম্পর্কে নানা তথ্য প্রচার লাভ করতে থাকে। তখন থেকে বিদ্যাপতিকে বাঙালি কবি বলে গ্রহণ করতে আর কোনো উপায় থাকল না।

১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে জগবন্ধু ভদ্র শুধু বিদ্যাপতির পদ নিয়ে ‘মহাজন পদাবলী’ প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে অক্ষয় চন্দ্র সরকার সম্পাদিত ‘প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ’ দ্বিতীয় খণ্ডে বিদ্যাপতির পদাবলী গৃহীত হয়েছে। সারদাচরণ মিত্র ‘বিদ্যাপতির পদাবলী’ প্রকাশ করেন ১২৮৫ বঙ্গাব্দে। তাঁর এই সংস্করণকে মার্জিত করে এবং মিথিলা ও নেপাল থেকে অনেক পদ সংগ্রহ করে নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ১৩১৬ খ্রীষ্টাব্দে ৮৪০টি বিদ্যাপতির পদের এক বৃহত্তম কাব্য সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তারপর খগেন্দ্রনাথ মিত্র, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ ও ডঃ বিমানবিহারী মজুমদারের সম্পাদনায় বিদ্যাপতির পদাবলী নানা তথ্য ও বিস্তৃত ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়েছে।

বিদ্যাপতির জীবন ইতিহাস
ছবির সূত্র : ইন্টারনেট

বিভিন্ন মতামত


হিন্দী ও মৈথিলীতেও বিদ্যাপতির অনেকগুলি পদাবলী সংগৃহীত হয়েছে। সম্পাদকগণ সেগুলো নেপালী পুঁথি ও মিথিলায় প্রচলিত পুঁথির উপর বেশি নির্ভর করেছেন। তাঁরা বাংলাদেশে বিভিন্ন মতামত বিদ্যাপতির পদসংকলনে গৃহীত পদাবলীর তেমন মর্যাদা দেননি। তাঁদের মতে বিদ্যাপতির রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদগুলি উৎকৃষ্ট নয়। সেগুলি নিছক শৃঙ্গার রসের কবিতা। তাঁদের মতে হরগৌরী বিষয়ক পদগুলি মিথিলার বিশেষভাবে সমাদৃত। সংকলকরা বিদ্যাপতির শৈবপদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিয়েছেন।

সে যাহোক, জন বীম্‌স্‌, গ্রীয়ার্সন, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, সতীশচন্দ্র রায়, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ ও ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার প্রভৃতি পণ্ডিতগণ বিদ্যাপতি সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য আবিষ্কার করেছেন। প্রসিদ্ধ মৈথিলী পণ্ডিত ডঃ উমেশ মিশ্র, ডঃ জয়কান্ত মিশ্র, রামকৃষ্ণ বেনিপুরী ও ব্রজনন্দন সাহা প্রমুখ অবাঙালি পণ্ডিতগণ বিদ্যাপতির কুল পরিচয় ও পদাবলী সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য আবিষ্কার করেছেন। সেই সমস্ত থেকে বিদ্যাপতির জীবনী সম্পর্কে সামগ্রিক একটা পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে। বিদ্যাপতি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলে যাননি। একটি কবিতার (‘পদসমুদ্র‘ শীর্ষক সংকলন গ্রন্থ) কবি নিজের পরিচয় প্রসঙ্গে বলেছেন–

জনম দাতা মোর গণপতি ঠাকুর

মৈথিল দেশে করু বাস।

পঞ্চ গৌড়াধিপ শিবসিংহ ভূপ,

কৃপা করি লেউ নিজ পাশ।।

বিসফি গ্রাম দান করল মুঝে

রহতাহি রাজ সন্নিধান 

লছিমা চরণ ধ্যানে কবিতা নিকশয়ে

বিদ্যাপতি হই ভাণ।

মিথিলায় প্রচলিত রাজপঞ্জীতে মিথিলার রাজবংশ ও ব্রাহ্মণ সমাজ সম্বন্ধে অনেক তথ্য আছে। সন তারিখের মধ্যে কিছুটা বৈষম্য আছে এই যা। রাজপঞ্জী ও বাঙালি অবাঙালি পণ্ডিতদের গবেষণা নিবন্ধ থেকে বিদ্যাপতির বংশ পরিচয় ও জীবনেতিহাসের একটা পূর্ণাঙ্গ পরিচয় গড়ে তোলা যায়।

আরো পড়ুন--  শাহ মুহম্মদ সগির এবং ইউসুফ জোলেখা

বাংলা-মিথিলার সাংস্কৃতিক যোগাযোগ


এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, বাংলা মিথিলার সাংস্কৃতিক আদান প্রদান-এর পূর্বে দুশো বছর ধরে চলছিল। বাঙালি জয়দেবের গীতগোবিন্দের মধুর কোমলকান্ত পদাবলী ভারতবর্ষের অপরাপর সংস্কৃতি কেন্দ্রের মতো মিথিলাতেও প্রচারিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে, ১১১৯ খ্রীষ্টাব্দে বল্লাল সেন নেপাল ও মিথিলা জয় করেন। সেই বৎসর থেকে লক্ষ্মণ সংবং (লসং) প্রবর্তিত করেন। তখন থেকে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ মিথিলায় লক্ষ্মণ সংবতের প্রচলন বেশি। মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের সভায় স্মৃতি ও মীমাংসা চর্চার ইতিহাস ভারত বিখ্যাত। তাঁর সভাপণ্ডিত হলায়ুধ মিশ্র এবং ভ্রাতৃদ্বয় পশুপতি ও ঈশানের স্মৃতিগ্রস্থ ও অন্যান্যদের স্মৃতি মীমাংসাচর্চা মিথিলাকে প্রভাবিত করে। বিদ্যাপতির ‘শৈব সর্বস্বসার’, হলায়ুধের শৈব সর্বস্ব’, ‘ব্রাহ্মণ সর্বস্ব’, ‘বৈষ্ণব সর্বস্ব’ ও ‘পণ্ডিত সর্বস্ব’ গ্রন্থের প্রভাব স্মরণ করিয়ে দেয়। বিদ্যাপতির ‘বিভাগ সার’, ‘দান বাক্যাবলী’ জীমূতবাহনের ‘দায় ভাগে’র আদর্শানুযায়ী।

সংক্ষিপ্ত জীবনী


যাহোক, বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বিদ্যাপতির জন্মস্থান দ্বারভাঙ্গা জেলার মিথিলার সীতামারি অন্তর্গত বিসফিগ্রাম। তাঁর পিতা গণপতি ঠাকুর, পিতামহ জয়দত্ত, প্রপিতামহ ধীরেশ্বর। এই তিনপুরুষ ব্রহ্মণোচিত যজন যাজন অধ্যয়ন অধ্যাপনের বৃত্তিধারী ছিলেন। কিন্তু ধীরেশ্বরের ভ্রাতা বীরেশ্বর (মিথিলাস্মৃতি সুপ্রসিদ্ধ ‘বীরেশ্বর-পদ্ধতির রচয়িতা) এবং তদুর্ধ্ব চার পুরুষ, দেবাদিত্য, কর্মাদিত্য, হরাদিত্য ও বিষ্ণুনাথ উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন। বীরেশ্বর সান্ধিবিগ্রহিক এবং রাজসম্মানলাভ ও শাস্ত্রানুশীলনের, বিশেষ করে স্মৃতিচর্চার বংশধারাগত ঐতিহ্য বিদ্যাপতির মনোজীবনে প্রভাব বিস্তার করে তাঁকে মিথিলার তথা প্রাচ্য-ভারতের পণ্ডিতসমাজে বরণীয় করে তুলেছিল।

কবির দুলহা নামে এক কন্যা, চন্দ্রকলা নামে কবিখ্যাতিসম্পন্না পুত্রবধূ, প্রথম পক্ষের পুত্র হরপতি ও নরপতি এবং দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র বাচস্পতি ছাড়া আর কোনও স্বজনের নাম মিথিলার প্রবাদে নেই। দীর্ঘজীবী কবি ব্রহ্মণরাজবংশের (ওইনীবার বংশ বা কামেশ্বর বংশ) ছ’সাত জন রাজা এবং দু’তিন জন রাণীর (কীর্তিসিংহ, দেবসিংহ, শিবসিংহ ও লছিমাদেবী, পদ্মসিংহ ও বিশ্বাসদেবী, নরসিংহ ও ধীরমতী, ভৈরবসিংহ) এবং দ্রোণবারের রাজা পুরাদিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃত ও অবহট্ট ভাষায় নানা গ্রন্থ রচনা করেন। ‘দেশিল বঅনা’ অর্থাৎ মৈথেলী ভাষায় তিনি রাধাকৃষ্ণলীলাত্মক অজস্র উৎকৃষ্ট পদ, হরগৌরী, সীতা-রাম ও গণেশ সম্পর্কে কিছু পদ এবং প্রহেলিকাজাতীয় কয়টি পদ রচনা করেন।

পৃষ্ঠপোষক রাজা ও পৃষ্ঠপোষিকা রাণী ছাড়া রাজবংশের এবং মন্ত্রিবর্গের অনেকের নাম কবি উল্লেখ করেছেন। রাজা শিবসিংহ কবিকে ২৯৩ লক্ষ্মণ সংবতে (১৪১২ খ্রীষ্টাব্দে) ‘বিস্তীর্ণ নদীমাতৃক সারণ্য রসবোবর’ বিসফি গ্রাম দান করেন। তাম্রশাসনে উৎকীর্ণ এই দানপত্রে মিথিলায় প্রচলিত লক্ষ্মণ সংবতের সঙ্গে অপরাপর সংবৎ এমন কি, আকবর বাদশাহের সময়ে এদেশে প্রবর্তিত ফজলী হিজরীসনের উল্লেখ থাকায় এবং এই সমস্ত সনের মধ্যে পারস্পরিক সঙ্গতি না থাকায় এই তাম্রশাসনখানিকে কেউ কেউ জাল মনে করেন। কিন্তু দানপত্রখানি জাল না-ও হতে পারে। হয়ত কবির বংশধরেরা পরবর্তী কোনো উপলক্ষে স্বত্ব প্রমাণ করবার জন্য বিনষ্ট দানপত্রের নকল প্রস্তুতিকালে নতুন এবং ভ্রমাত্মক অতিরিক্ত সন যোজনা করেছিলেন।

বিদ্যাপতির জন্মমৃত্যুর কালনির্ণয় নিয়ে এ-পর্যন্ত ঐকমত্য হয়নি। অনুমাননির্ভর বিচার-বিতর্কের সাহায্যে কবির দীর্ঘজীবিতার স্বীকৃতির সঙ্গে এই সিদ্ধান্তে আসা গিয়েছে যে কবি আনুমানিক চতুর্দশ শতকের তৃতীয় পাদ থেকে পঞ্চদশ শতকের তৃতীয় পাদ পর্যন্ত কিছু কম-বেশি একশো বছর জীবিত ছিলেন। অনুমানের কারণগুলি সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাচ্ছে। বিদ্যাপতির একটি পদে (খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও বিমানবিহারী মজুমদারের ‘বিদ্যাপতির পদাবলীর’ ৯৩২ সংখ্যক পদে) নসরৎ শাহের উল্লেখ আছে। নসরৎ শাহ ১৩৪৪ খ্রীষ্টাব্দে জৌনপুরের আধিপত্য লাভ করে ১৩১৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। সুতরাং ১৩৯৯ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে বিদ্যাপতি বিদ্যমান ছিলেন।

পঞ্চদশ শতকের প্রথম দশকে অবহট্ট ভাষায় রচিত কীর্তিতলায় কবি নিজেকে ‘খেলন কবি’ বলে তাঁর ভাষায় উপমা দিয়েছেন বালচন্দ্রের সঙ্গে। ইতিহাসকৌতূহলী কবি নিশ্চয়ই তখন তারুণ্যের সীমা অতিক্রম করেননি। এইরূপ গণনায় তাঁর সম্ভাবিত, জন্মকাল চতুৰ্দশ শতকের তৃতীয় পাদের শেষের দিকে ধরা যায়। কীর্তিলতার কিছু আগে তিনি (নৈমিষারণ্যে বাসকালে) ভূ-পরিক্রমা এবং কিছু পরে ‘পুরুষপরীক্ষা’ নামক আখ্যায়িকা-মূলক গ্রন্থ লেখেন। ভূগোল ও ইতিহাস রচনার আগ্রহে খেলন-কবির প্রতিভার উন্মেষ হয়।

আরো পড়ুন--  কবি জ্ঞানদাস, 16শ শতকের কবি

পুরুষ-পরীক্ষা ও কীর্তিপতাকা শিবসিংহের সময়ে রচিত হয়। শিবসিংহের রাজত্বকাল ১৪১০-১৪১২/১৪১৪ খ্রীষ্টাব্দে ‘সপ্রক্রিয় অভিনব-জয়দেব’ শিবসিংহের নিকট থেকে বিসফি গ্রাম লাভ করেন। এই সময় তিনি ক্রিয়ান্বিত ব্রাহ্মণ এবং কবিখ্যাতিতে জয়দেব-গোত্রীয়। কবির বয়স তখন ৪০- এর কাছাকাছি। তার শ্রেষ্ঠ রচনা রাধাকৃষ্ণলীলাত্মক পদাবলীর বহুলাংশ এই সময়ে রচিত হয়ে থাকবে, যার জন্য তাঁর কবি-কৃতি পূর্বসূরী জয়দেবের প্রতিষ্ঠাকে স্পর্শ করেছে। ‘কাব্য প্রকাশ- বিবেকের একখানি পুঁথি বিদ্যাপতির আদেশে ১৪১০ খ্রীষ্টাব্দে নকল করা হয়। এই নকলে বিদ্যাপতিকে ‘সপ্রতিষ্ঠ সদুপাধ্যায় বলা হয়েছে। অন্তত ৩৫ বৎসর বয়সের পূর্বে প্রতিষ্ঠাপন্ন উপাধ্যায় হওয়া স্বাভাবিক মনে হয় না।

১০২৮ খ্রীষ্টাব্দে দ্রোণবারের আশ্রয়ে বাসকালে বিদ্যাপতি স্বহস্তে শ্রীমদ্ভাগবতের একখানি নকল প্রস্তুত করেছিলেন। কবির বয়স তখন পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে, ভাগবত-নকলেরই প্রকৃষ্ট কাল। হয়ত এ-সময়ে তাঁর উন্নততম স্তরের বৈষ্ণবপদাবলীগুলির কিয়দংশ রচিত হয়েছিল। ১৪৪০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কবি পদ্মসিংহ ও বিশ্বাসদেবীর নির্দেশে শৈব সর্বস্বসার’ এবং ‘গঙ্গাবাক্যাবলী’ রচনা করেন। পরিণত বয়সেরই উপযোগী স্মৃতিগ্রন্থ এ-দুখানি। ১৪৪০ খ্রীষ্টাব্দের পরে তিনি ‘বিভাগসার’ ও ‘দানবাক্যাবলী’, দায়ভাগ জাতীয় এই দুখানি গ্রন্থ রচনা করে ব্যবহারশাস্ত্রে পরিণত চিস্তার পরিচয় দেন। তাঁর সর্বশেষ প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ ধর্মব্যবস্থাপক স্মার্তেরই উপযোগী।

১৪৬০ খ্রীষ্টাব্দে বিদ্যাপতির জীবিত থাকার একটি প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সময়ে তিনি একটি ছাত্রকে হলায়ুধের ‘ব্রাহ্মণ-সর্বস্ব’ পড়িয়েছিলেন। ঈশান নাগরের ‘অদ্বৈত প্রকাশে’ আছে, অদ্বৈতাচার্যের মিথিলা- পরিভ্রমণ-কালে তিনি বয়োভার নত মৈথিল কবির দেখা পেয়েছিলেন। যৌবনে পাঠসমাপ্তির পর অদ্বৈতের মিথিলাভ্রমণ ধরলে এই ঘটনার মধ্যে কোন অসঙ্গতি দেখা যায় না। তা হ’লে দেখা গেল, মিথিলায় বিদ্যাপতির তিরোভাব পঞ্চদশ শতাব্দীর তৃতীয়পাদে, নবদ্বীপে মহাপ্রভুর আবির্ভাব ঐ শতাব্দীর চতুর্থপাদে। ব্যবধান মাত্র শতাব্দীর একটি পাদের।

কামেশ্বর রাজবংশের উত্থান-পতনের সঙ্গে কবির অদৃষ্ট ও কবিকর্ম বিজড়িত ছিল। কামেশ্বরের পৌত্র গগনেশ। (গগনেশ বা গণেশ) ১৩৭১ খ্রীষ্টাব্দে (২৫২ লক্ষ্মণ সংবতে) মুসলমান আক্রমণকারী অসলানের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। তাঁর পুত্র কীর্তিসিংহ জৈনপুরের অধিপতি ইব্রাহিম শাহের সাহায্যে অসলানকে পরাজিত করে পিতৃরাজ্য উদ্ধার করেন। কীর্তিসিংহের এই বীরকীর্তি এবং মিথিলার তদানীন্তন রাজনীতিক দুর্যোগ ও সমাজবিপ্লব লক্ষ করে অবহট্ট ভাষায় কবি ‘কীর্তিলতা’ রচনা করে যুগদুর্লভ ঐতিহাসিক ও সামাজিক চেতনার পরিচয় দেন।

অসলানের অধিকারকালে কবি বোধ হয় মিথিলা ত্যাগ করে দেবীসিংহের সঙ্গে নৈমিষারণ্যে বাস করেন। এই সময়ে তিনি মিথিলা থেকে নৈমিষারণ্য পর্যন্ত তীর্থ বর্ণনা করে “ভূপরিক্রমা’ রচনা করেন। এইটিই বোধ হয় তাঁর প্রথম রচনা। দেবীসিংহ স্বল্পকাল রাজত্ব করেন। পুত্র শিবসিংহের হাতে রাজ্য অর্পণ করেন। পূর্বেই বলা হয়েছে, আখ্যায়িকামূলক ‘পুরুষ- পরীক্ষা’ ও ‘কীর্তিপতাকা’ প্রায় সমকালে শিবসিংহের শাসনকালে (১৪১০-১৪১৪) রচিত হয়। এবং তাঁর উৎকৃষ্ট রাধাকৃষ্ণ-লীলাত্মক পদাবলীর বহুলাংশ এই সময়ে রচিত হয়। বহু পদে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাভরে কবি শিবসিংহ ও তৎপত্নী লছিমা-দেবীর উল্লেখ করেছেন।

শিবসিংহের রাজত্বকাল মাত্র চার বৎসর স্থায়ী হয়েছিল (১৪১০-১৪১৪)। ১৪১৪ খ্রীষ্টাব্দে মিথিলার আকাশে আবার রাষ্ট্রবিপ্লবের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। মুসলিম আক্রমণে রাজা শিবসিংহ নিহত অথবা নিরুদ্দেশ হন। ভাগ্যবিড়ম্বিত কবি কিছুদিনের জন্য বাসভূমি পরিত্যাগ করে দ্রোণবারের অধিপতি পুরাদিত্যের আশায় বাস করেন। তাঁরই আদেশে কবি সংস্কৃতে ‘লিখনাবলী’ (পত্র লিখনের আদর্শ) রচনা করেন। মিথিলায় ফিরে এসে তিনি বাকি জীবন স্বদেশে বাস করেন এবং রাজাদেশে সংস্কৃতে তাঁর প্রসিদ্ধ স্মৃতিমীমাংসার গ্রন্থগুলি রচনা করেন। সংবৎসরের করণীয় পুণ্যকর্ম বিষয়ে তিনি ‘বর্ষ নির্ণয়’ ও তীর্থমাহাত্ম্য অবলম্বনে ‘গয়াপত্তন ‘ রচনা করেন। ‘গোরক্ষোপাখ্যান’ নামে তাঁর একখানি নাটকের কথা মিথিলাবাসীরা বলে থাকেন।

শেষের কথা


বিদ্যাপতির আবির্ভাব ও মৃত্যু সম্পর্কে সঠিক কাল নির্ণয় অসম্ভব। বাঙালি ও অবাঙালি পণ্ডিতদের মতানুসারে আমরা বলতে পারি যে, বিদ্যাপতি ১৩৮০ খ্রীষ্টাব্দে বা এর সামান্য কিছু পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ বা দ্বিতীয়ার্ধের কিছুকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। মিথিলায় প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে মৃত্যুকালে বিদ্যাপতির বয়স নব্বই বছর হয়েছিল। বিদ্যাপতির মৃত্যু সম্পর্কে এক কাহিনী মিথিলায় প্রচলিত। শিবসিংহের মৃত্যুর (বা নিরুদ্দেশের) বত্রিশ বছর পরে বিদ্যাপতি শিবসিংহকে স্বপ্নে দেখেন। শিবসিংহ গৌরবর্ণ ও প্রিয় দর্শন ছিলেন বলে তাঁর উপনাম ছিল রূপনারায়ণ। কিন্তু স্বপ্নে শিবসিংহ কৃষ্ণবর্ণ হয়ে দেখা দেন। পুরাণমতে এরূপ স্বপ্ন আসন্ন মৃত্যু সূচক। এ সম্পর্কে কবির জবানীতে একটি পদ পাওয়া যায়—

আরো পড়ুন--  পদাবলির কবি চণ্ডীদাস, 15শ শতকের কবি

সপন দেখল হম শিবসিংহ ভূপ।

বতিস বরস পর সামর রূপ।। 

বহুত দেখল গুরুজন প্রাচীন।

আর ভেলুহুঁ হম আয়ু বিহীন।।

মিথিলার প্রথানুযায়ী আসন্ন মৃত্যু বিদ্যাপতিকে গঙ্গাতটে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক আগেই তিনি গঙ্গাতটে দেহত্যাগের অভিলাষ ব্যক্ত করেন। পুত্র-কন্যাদের উপদেশ দিয়ে বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে, কুলদেবী বিশ্বেশ্বরীকে প্রণাম করে বিদ্যাপতি গঙ্গাতটে যান। জনশ্রুতি অনুযায়ী লক্ষ্মণাব্দ ৩২৯ সালের কার্তিক মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে তিনি দেহরক্ষা করেন। শোনা যায় বিদ্যাপতির চিতার উপর এক শিবলিঙ্গ প্রকট হয়ে ওঠে। এখনো সেখানে এক শিব মন্দির আছে। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে সেখানে মেলা বসে।

আসল কথা বিদ্যাপতি অসামান্য কবিখ্যাতির অধিকারী ছিলেন। তাই তাঁর জীবনী সম্পর্কে মিথিলা ও বাংলায় ভিত্তিহীন অনেক লোকরঞ্জক কিংবদন্তী গড়ে উঠেছে। শিবসিংহের পত্নী লছিমাদেবীর সঙ্গে বিদ্যাপতির গোপন প্রণয় ও বাংলা দেশে গঙ্গাতীরে বিদ্যাপতি ও পদকর্তা চণ্ডীদাসের মিলন এবং প্রেমমনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা – বিদ্যাপতির ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে তাঁর গৃহে দাসরূপে শিবের অবস্থান, মৃত্যুকালে বিদ্যাপতির কাছে গঙ্গানদীর আগমন প্রভৃতি অন্যতম। এগুলির তেমন কিছু মূল্য নেই। বিদ্যাপতির বিপুল জনপ্রিয়তা থেকে এই সব গালগল্প গড়ে উঠেছে।

বিদ্যাপতির জন্ম ও বংশ সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য


“বিদ্যাপতির বংশগত উপাধি ঠাকুর, যার অর্থ জমিদার। বিদ্যাপতির জন্ম শুক্ল যজুর্বেদ শাখার কাশ্যপ গোত্রভুক্ত মাধ্যন্দিন শাখার অন্তর্গত মৈথিল ব্রাহ্মণ পরিবারে।” (বিদ্যাপতি/ রমানাথ ঝা অনু. ঈশানী হাজরা/ সাহিত্য অকাদেমি/ ১৯৯৫/ ভারতীয় সাহিত্যকার পুস্তকমালা/ পৃ. ৩)

“বিদ্যাপতির জন্মসময় সঠিকভাবে জানা না গেলেও শোনা যায় তিনি শিবসিংহের চেয়ে দু-বছরের বড়। শিবসিংহ তাঁর পিতার মৃত্যুর পর যখন সিংহাসনে বসেন তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ বছর এবং তিনি নিজস্ব অধিকারে রাজ্যলাভ করেন ১৯৩ লক্ষ্মণ সম্বতের চৈত্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের ষষ্ঠীতে, … ১৩২৪ শকাব্দে বা ১৪০২ খ্রি.। এর থেকে অনুমান করা যায় বিদ্যাপতির জন্ম ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে বা তার কাছাকাছি অর্থাৎ কর্ণাট বংশ পতনের ২৭ বছর পর এবং জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ‘বর্ণরত্নাকর’ রচনার ২৫ বছরের মধ্যে।” (বিদ্যাপতি/ রমানাথ ঝা অনু. ঈশানী হাজরা/ সাহিত্য অকাদেমি/ ১৯৯৫/ ভারতীয় সাহিত্যকার পুস্তকমালা/ পৃ. ৫)

“বিদ্যাপতি ১৪শ শতাব্দীর শেশভাগ থেকে (আনুমানিক ১৩৮০ খ্রি. অ.) ১৫শ শতাব্দীর মধ্যভাগেরও কিছু পরে (আনু. ১৪৬০ খ্রি. অ.) জীবিত ছিলেন। তাঁর বয়স সম্ভবত আশী বছর হয়েছিল, কিছু বেশিও হতে পারে।” (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড)

বিদ্যাপতির উপাধি অভিনব জয়দেব ও কবিকণ্ঠহার


“[নবাব কর্তৃক] বিদ্যাপতি ভূষিত হন ‘কবিশেখর’ উপাধিতে। রাজ্যলাভ করে শিবসিংহ বিদ্যাপতিকে তাঁর আদিগ্রামের স্বত্ত্ব প্রদান করেন ও নতুন উপাধি দেন ‘অভিনব জয়দেব’। … [শিবসিংহ] বিদ্যাপতিকে তাঁর ছয়পত্নীর রক্ষণাবেক্ষণের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে যান।” (বিদ্যাপতি/ রমানাথ ঝা অনু. ঈশানী হাজরা/ সাহিত্য অকাদেমি/ ১৯৯৫/ ভারতীয় সাহিত্যকার পুস্তকমালা/ পৃ. ৯)

“… দুটি সম্মানজনক উপাধির উল্লেখ আছে তাঁর নাটক ‘গোরক্ষবিজয়ে’ বিসপি-দান সংক্রান্ত তাম্রপত্রে, লোকপরম্পরা এবং সর্বোপরি তাঁর ভণিতা দ্বারা সমর্থিত; এগুলি হল ‘অভিনব জয়দেব’ অর্থাৎ ‘এক আধুনিক জয়দেব’ এবং ‘কবিকণ্ঠহার’।” (বিদ্যাপতি/ রমানাথ ঝা অনু. ঈশানী হাজরা/ সাহিত্য অকাদেমি/ ১৯৯৫/ ভারতীয় সাহিত্যকার পুস্তকমালা/ পৃ. ৩০)


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!