Last Updated on January 15, 2022 by বাংলা গাইড
বৃন্দাবন দাসের পরিচয় | চৈতন্যভাগবত কাব্যের পরিচয়
| চৈতন্যভাগবত কাব্যের রচনাকাল
প্রাথমিক পরিচয় (আনু. ১৫১৯ খ্রীঃ) :
বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম চৈতন্যচরিত গ্রন্থ বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত‘। পরবর্তীকালে কোন কোন কাব্যে গ্রন্থটির নাম ‘চৈতন্যমঙ্গল’ও পাওয়া যায়। যেমন ‘প্রেমবিলাস‘ কাব্যে এই গ্রন্থের নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে : “বৃন্দাবন মহান্তেরা ভাগবত আখ্যা দিল।” বৃন্দাবন দাসের গ্রন্থে নবদ্বীপে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচলিত রূপটি প্রতিফলিত হয়েছে। কবির ঐশ্বর্যমিশ্র ভক্তির দৃষ্টিতে শ্রীচৈতন্যদেব কৃষ্ণ এবং রামচন্দ্রের অবতার রূপে কল্পিত। এই অবতার কল্পনার কারণ, যুগসঙ্কটের কালে পাষণ্ডী-দমন ও সাধুদের পরিত্রাণের জন্য শ্রীচৈতন্যদেবের অনিবার্য আবির্ভাব।
বৃন্দাবন দাস প্রত্যক্ষভাবে চৈতন্যলীলা দর্শন করেন নি। কারণ কবির নিজের উক্তি “হইল মনুষ্যজন্ম না হইল দরশন।” নিত্যানন্দ-শিষ্য বৃন্দাবন দাসের জীবন সম্পর্কে সবিশেষ জানা যায় না। গ্রন্থ সাক্ষ্যে বোঝা যায়, শ্রীবাসের ভ্রাতুষ্পুত্রী নারায়ণী দেবী ছিলেন কবির মাতা। কবির পিতৃপরিচয় অজ্ঞাত। ড. বিমানবিহারী মজুমদারের মতে, নবদ্বীপে আনুমানিক ১৫১৯ খ্রীস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে কবির জন্ম হয়। পরে দেনুড় গ্রামে কবি বসবাস করেন।
চৈতন্যভাগবতের রচনাকাল :
ড. বিমানবিহারী মজুমদারের মতে ১৫৪৮ খ্রীস্টাব্দ। আদি, মধ্য ও অন্ত্য এই তিনটি খণ্ডে গ্রন্থটি লেখা হয়। আদিখণ্ডে ১৫ অধ্যায় চৈতন্যের গয়া প্রত্যাগমন পর্যন্ত বর্ণিত। মধ্যখণ্ডে আছে ২৭ অধ্যায়, চৈতন্যের সন্ন্যাস গ্রহণ পর্যন্ত বিবরণ। অন্ত্যখণ্ডে দশ অধ্যায়, গৌড়ীয় ভক্তদের সঙ্গে মিলন ও গুণ্ডিচা-যাত্রা মহোৎসব বর্ণিত।
কাব্য-পরিচয় :
বিশ্বাসের-বন্দর ছাড়িয়ে ব্যাকুলতার হাওয়ায় পাল তুলে কবির জীবনতরী ভক্তির স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলেছে। চৈতন্য-নিত্যানন্দ তাঁর কাব্যে কৃষ্ণ-বলরামের অবতার। আদিলীলা বর্ণনার সময়েও কবি অবিস্মৃত “বিদ্যারসে বৈকুণ্ঠের নায়ক বিহারে।” দাস্যভাবের উপাসক কবি সমর্পণের তর্পণে তনু-মন উৎসর্গ করে মহাপ্রভুর জীবনকে ঐশ্বর্যরাগে চিত্রণে প্রয়াসী। তবু চৈতন্যদেবের মানবিক পরিচয়ে গ্রন্থটি আদ্যত্ত উদ্দীপ্ত। মধ্যযুগের সাহিত্য যখন একান্তভাবে দেবপ্রধান, মাটি ও মানুষের স্থান যখন সঙ্কুচিত, তখন এহেন কাব্যে মানুষী ভাবের পরিচয় অবশ্যই প্রশংসার্হ। গঙ্গাদাস পণ্ডিতের সঙ্গে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে চৈতন্যদেবের মানবিক পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছে :
“আমি যে বাখানি সূত্র করিয়া খণ্ডন।
নবদ্বীপে তাহা স্থাপিবেক কোন জন ॥
নগরে বসিয়া এই পড়াইব গিয়া
দেখি কার শক্তি আছে দুষুক আসিয়া ॥”
কোমলতা-জড়িত পৌরুষে তার চৈতন্য চরিত্র অনশ্বর। তাঁর কাব্যের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য-ইতিহাসের বিশ্বস্ত বিবরণ। চৈতন্যপূর্ব নবদ্বীপ বর্ণনায় ব্যভিচার-উন্মত্ত সমাজের যে চিত্রাল্পনা পরিস্ফুট, তা বাংলার তামসিক পরিবেশ-শাসিত ঐতিহাসিক নিষ্ঠার ফসলঃ
“নবদ্বীপ-সম্পত্তি কে বর্ণিবারে পারে।
এক গঙ্গাঘাটে লক্ষ লোক স্নান করে।।
ত্রিবিধ বেসে এক জাতি লক্ষ লক্ষ।
সরস্বতী প্রসাদে সবেই মহাদক্ষ।।”
বা,
“সকল সংসার মত্ত ব্যবহার রসে।
কৃষ্ণপূজা বিষ্ণুভক্তি নাহি করো বাসে ৷৷
বাশুলী পুজয়ে কেহ নানা উপহারে।
মদ্য মাংস দিয়া কেহ যক্ষ পূজা করে ৷৷
নিরবধি নৃত্যগীত বাদ্য কোলাহল।
না শুনে কৃষ্ণের নাম পরম মঙ্গল ॥”
পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের মোহনায় হোসেন শাহর রাজত্বকালের চালচিত্রে নৈতিক ধ্বংসস্তূপের উপরে সামাজিক জীবনে ব্যভিচারের যে ধ্বস্ নেমেছিল, এ গ্রন্থের পাতায় পাতায় তা বাস্তবজীবনের এক রঙীন রেখাচিত্র, “হঠাৎ আলোর ঝলকানি।”
গ্রন্থটির মূল্যায়ন :