বৈদিক সাহিত্যের সাধারণ পরিচিতি : বৈদিক সাহিত্যের সাধারণ পরিচিতি অর্থাৎ বৈদিক সাহিত্য বলতে প্রকৃতপক্ষে কী বোঝায় এবং এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের সংক্ষিপ্ত ধারণা।
বৈদিক সাহিত্যের সাধারণ পরিচিতি
সুদূর অতীতে আর্যদের সভ্যতা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ভারত ভূমিতে স্বয়ং উদ্ভূত হয়েছিল এক পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য যার মধ্যে বিধৃত আছে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ। পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যদেশ যখন জ্ঞানের প্রদীপ্ত শিখার অভাবে সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে গহন তমিশ্রায় আচ্ছন্ন, সে সময় আর্যসভ্যতার জ্ঞানগরিমায় ভারতবর্ষ মহীয়ান। ঋক্সংহিতার কাল থেকে বেদাঙ্গ রচনার অন্তিম পর্ব পর্যন্ত যে সুবিশাল সাহিত্য কেবল ভারতীয় সংস্কৃতির নয়, বিশ্বসংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক গৌরবোজ্জ্বল যুগের সূচনা করেছিল তাকেই বৈদিকসাহিত্য নামে অভিহিত করা হয়। এই সাহিত্যকে পৃথিবীর উন্নততম প্রাচীন সাহিত্য বললেও অত্যুক্তি হয় না।
জ্ঞানার্থক ‘বিদ্’ ধাতুর উত্তর অচ্ প্রত্যয় যোগে ‘বেদ’ শব্দ নিষ্পন্ন। ‘বেদ’ কথাটির অর্থ-জ্ঞান। জ্ঞান বলতে পরমজ্ঞানই এখানে বোধ্য। এই জ্ঞান পার্থিব জ্ঞান বা ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অতীন্দ্রিয় জ্ঞান। সেই অতীন্দ্রিয় পরম জ্ঞান যে শাস্ত্র থেকে লাভ করা যায় তাকেই বলা হয় বেদ। তাই যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন-
“প্রত্যক্ষেণানুমিত্যা বা যস্তূপায়ো ন বিদ্যতে।
এনং বিদন্তি বেদেন তস্মাদ্ বেদস্য বেদতা।।”
সংহিতাকার মনুর মতে বেদ হল সমস্ত ধর্মের মূল- “বেদঃ অখিলধর্মমূলম্” (মনু, ২/৬)। সায়ণাচার্যের মতে ইষ্টপ্রাপ্তি ও অনিষ্ট পরিহারের উপায় যে গ্রন্থ থেকে লাভকরা যায় তাই বেদ- “ইষ্টপ্রাপ্তন্ত্র্যনিষ্টপরিহারয়োরলৌকিকমুপায়ং যো গ্রন্থো বেদয়তি স বেদঃ” (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ভাষ্যভূমিকা)।
বস্তুতঃ ধর্ম, কর্মফল, যজ্ঞ, যজ্ঞফল, স্বর্গ, পরলোকতত্ত্ব, অদৃষ্ট ইত্যাদি যাবতীয় জ্ঞান এবং ব্রহ্ম, মোক্ষ প্রভৃতি বিষয়ক জ্ঞানের আকরস্বরূপ এই বেদ। বেদ নিত্য, অভ্রান্ত, স্বতঃসিদ্ধ, সনাতন ও অপৌরুষেয়। পরমব্রহ্মের নিঃশ্বাসরূপে বেদ স্বপ্রকাশ, ঋষিগণ মন্ত্রদ্রষ্টা মাত্র। শ্রুতি, ত্রয়ী, আগম, ছন্দস্ প্রভৃতি বেদের প্রতিশব্দ। আচার্য-শিষ্য-পরম্পরায় বেদ শ্রবণের মাধ্যমেই রক্ষিত হত বলে এর আর এক নাম ‘শ্রুতি’। অনেকের মতে ঋক্, সাম, যজুঃ-এই তিনটি বেদের সমষ্টিকে বলা হয় ‘ত্রয়ী’। পরবর্তীকালের সংযোজন বলে অথর্ববেদ ত্রয়ীর অন্তর্ভুক্ত নয়। আবার অনেকের মতে যজ্ঞের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত বলে ঋক্, সাম ও যজুঃ-এই বেদত্রয়কে ত্রয়ী বলা হয়। যজ্ঞসম্পাদনে অথর্ববেদের কোন ভূমিকা না থাকায় তা ত্রয়ীর অন্তর্ভুক্ত নয়। অপর একটি মতানুসারে বেদ ত্রিবিধ মন্ত্রলক্ষণাক্রান্ত, তাই-এর আর এক নাম ত্রয়ী।
ঋক্মন্ত্র পদ্যাত্মক, সামবেদের মন্ত্র গীতিময় এবং যজুর্বেদের মন্ত্র গদ্যাত্মক। অথর্ব বেদের মন্ত্র এই ত্রিবিধ লক্ষণান্বিত, তাতে কোন অভিনবত্ব নেই। সুতরাং ত্রিবিধ লক্ষণযুক্ত মন্ত্রসমষ্টিই হল ত্রয়ী।
বেদের মূলতঃ দুটি অংশ- মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ। তাই বলা হয়েছে-“মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম্”। বেদের মন্ত্রভাগে আছে দেবতাদের উদ্দেশ্যে স্তবস্তুতি, দেবমহিমা কীর্তন, দেবতার আহ্বান, অভীষ্ট বস্তুর প্রার্থনা প্রভৃতি। ব্রাহ্মণভাগে আছে- বিবিধ যাগযজ্ঞের বিস্তৃত বিবরণ, মন্ত্রের বিনিযোগ, ইতিহাস, পুরাকীর্তি, দেবতা, যজ্ঞফল প্রভৃতির বিস্তৃত আলোচনা। এককথায় বেদের মন্ত্রভাগ হল জ্ঞানকাণ্ড, আর ব্রাহ্মণভাগ হল কর্মকাণ্ড। বেদের মন্ত্রভাগ মূলতঃ পদ্যে রচিত, তবে কিছু কিছু অংশ গদ্যে নিবন্ধ। ব্রাহ্মণভাগ গদ্যে রচিত।
বৈদিক মন্ত্রের সংগ্রাহক গ্রন্থ সংহিতা নামে পরিচিত। সংহিতার সংখ্যা চার- ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব। প্রত্যেক সংহিতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্রাহ্মণ বিদ্যমান। প্রত্যেক মন্ত্র ব্রাহ্মণাত্মক বেদের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও দু’ধরণের গ্রন্থ পাওয়া যায়- আরণ্যক ও উপনিষৎ। বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্গত আর এক শ্রেণীর গ্রন্থ আছে যেগুলিকে বলা হয় বেদাঙ্গ। বেদাঙ্গ সংখায় ছয়টি- শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, ছন্দ, নিরুক্ত ও জ্যোতিষ। বেদের অর্থাগমের জন্য বেদাসের জ্ঞান অপরিহার্য।