সংস্কৃত গদ্যকাব্য : বৈদিক যুগেই গদ্য রচনার সূচনা হয়। যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় প্রথম গদ্য রচনার নিদর্শন পাওয়া যায়। তবে সংস্কৃত সাহিত্যের গদ্যের পরিমাণ পদ্যের তুলনায় অনেক কম।
Table of Contents
গদ্যকাব্য, সংস্কৃত গদ্যকাব্য, Prose Romance
সংস্কৃত গদ্যকাব্য কী
দৃশ্য ও শ্রব্য ভেদে কাব্য দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। শ্রব্যকাব্যের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে গদ্যকাব্য অন্যতম। গদ্যরচনাই হল কবিপ্রতিভার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয়ের মাপকাঠি। তাই বলা হয়ে থাকে—”গদ্যং কবীনাং নিকষং বদন্তি।” গদ্যকাব্যের স্বরূপ নির্ণয় প্রসঙ্গে কবি দণ্ডী বলেছেন—”অপাদঃ পদসন্তানো গদ্যম্।” ( দণ্ডী, কাব্যাদর্শ, ১/২৩) অর্থাৎ পাদবিহীন ও অর্থসমন্বিত পদসন্নিবেশই গদ্য। সাহিত্যদর্পণকার বিশ্বনাথ কবিরাজও ছন্দোবদ্ধ পাদবিহীন বৃত্তবন্ধকে গদ্য আখ্যায় চিহ্নিত করেছেন—”বৃত্তবন্ধোজ্ঝিতং গদ্যম্।” (সাহিত্যদর্পণ, ৬/৩০৯) এই গদ্যকাব্যের আবার বিভিন্ন অবান্তর ভেদ পরিলক্ষিত হয়। যেমন—কথা, আখ্যায়িকা, খণ্ডকথা, পরিকথা, এবং কথালিকা। তাই অগ্নিপুরাণে বলা হয়েছে—
"আখ্যায়িকা কথা খণ্ডকথা পরিকথা তথা।
কথালিকেতি মন্যন্তে গদ্যকাব্যঞ্চ পঞ্চধা।।"
গদ্যকাব্যের এই পাঁচটি বিভাগের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল “কথা ও আখ্যায়িকা”। অগ্নিপুরাণে, রুদ্রটের কাব্যালংকারে, ভামহের কাব্যালংকারে, হেমচন্দ্রের কাব্যানুশাসনে, বিশ্বনাথের সাহিত্যদর্পণে কথা ও আখ্যায়িকার স্বরূপ নিরূপিত হয়েছে।
সংস্কৃত গদ্যকাব্যের সূচনা কবে
ঠিক কবে কোন্ সময় থেকে সংস্কৃত গদ্যকাব্যের সূচনা–এ বৃত্তান্ত আজও রহস্যাবৃত। পণ্ডিতদের অনলস অধ্যবসায় এ বিষয়ে আজও কোন সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে নি। যজুর্বেদসংহিতা থেকে আরম্ভ করে ব্রাহ্মণ ও উপনিষদে গদ্য রচনার নিদর্শন পাওয়া যায়। বৈদিক কর্মকাণ্ডের যাগযজ্ঞ সংক্রান্ত নির্দেশগুলি গদ্যে রচিত। অথর্ববেদেও কিছু কিছু গদ্য রচনা পাওয়া যায়। বেদাঙ্গ এবং সূত্রসাহিত্য সংক্ষিপ্ত গদ্যরচনার পরিচয় বহন করে। পাণিনি-ব্যাকরণের বার্তিকসূত্রে কাত্যায়ন আখ্যায়িকার উল্লেখ করেছেন। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে সাবলীল গদ্যরচনাশৈলী পরিলক্ষিত হয়। মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি ‘বাসবদত্তা’, ‘সুমনোত্তরা’ এবং ‘ভৈমরথী’ নামে তিনটি গদ্যকাব্যের উল্লেখ করেছন। কিন্তু এই গদ্যকাব্যগুলি আজ কালগর্ভে বিলীন বলে এদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। ‘বৃহৎকথা’ নামটির সঙ্গে ‘কথা’ শব্দটি যুক্ত আছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ‘কথা’ ও ‘আখ্যায়িকা’ শব্দ দুটি অতি প্রাচীন। মহারাজা তথা কবি ভোজ তাঁর “শৃঙ্গারপ্রকাশে” বররুচির ‘চারুমতী’ ছাড়াও ‘মনোবতী’ ও ‘শাতকর্ণীহরণ’ নামক দুটি গদ্যরচনার কথা উল্লেখ করেছেন। সোমিলের ‘শূদ্রককথা’, শ্রীপালিতের ‘তরঙ্গবতী’, ধনপালের দ্বারা উল্লিখিত ‘ত্রৈলোক্যসুন্দরী’ (“সুশ্লিষ্টললিতা যস্য কথা ত্রৈলোক্যসুন্দরী”—তিলক মঞ্জরী) প্রভৃতি গদ্যকাব্য আজ নামমাত্রে পর্যবসিত।
কথা ও আখ্যায়িকা
আলংকারিক ভামহ কথা ও আখ্যায়িকার মধ্যে সুস্পষ্ট ভেদ নির্দেশ করেছেন তাঁর “কাব্যালংকার” গ্রন্থে। দণ্ডী উভয় গদ্যকাব্যকে একই শ্রেণীভুক্ত বলে মন্তব্য করেছেন—“তৎ কথাখ্যায়িকাত্যেকা জাতিঃ সংজ্ঞাদ্বয়াঙ্কিতা”। বাণভট্ট স্বরচিত হর্ষচরিতে ভট্টার হরিচন্দ্রের গদ্যরচনার প্রশংসা করেছেন— “ভট্টারহরিচন্দ্রস্য গদ্যবন্ধো নৃপায়তে।” এই সকল উল্লেখ থেকে বোঝা যায় যে, সংস্কৃত গদ্যসাহিত্যের ঊষর মরুতে দণ্ডী-সুবন্ধু-বাণের আকস্মিক আবির্ভাব ঘটে নি। এই গদ্যকাব্য রচয়িতাদের লেখনীতে যে সুবর্ণযুগ সূচিত হয়েছে তার পূর্বেও নিশ্চয়ই গদ্যকাব্যের একটা প্রস্তুতি পর্ব ছিল। পূর্বসূরীদের সেই সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দণ্ডী, সুবন্ধু ও বাণভট্ট গদ্যকাব্যের সুদৃশ্য সৌধ নির্মাণ করেছেন।
অমরকোষের সংজ্ঞা অনুসারে – যে রচনায় বাস্তব অভিজ্ঞতা ঐতিহাসিক ঘটনা বিবৃত হয় তাকে বলা হয় আখ্যায়িকা। এই শ্রেণির রচনায় লেখক নিজেই অনেকসময় নায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেন। অন্যদিকে যে রচনায় কাল্পনিক কাহিনি বিবৃত হয় তাকেই বলা হয় ‘কথা’। এখানে কাহিনিতে লেখক নিজে কোনো ভূমিকা গ্রহণ করেন না। যাইহোক এই বিভাজন স্বীকার করে নিলে বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ কে আখ্যায়িকা এবং কাদম্বরীকে কথা-র নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করা যায়।