Menu

সুভাষিত রত্নকোষ বা কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়

Last Update : January 12, 2024

সুভাষিত রত্নকোষ

তুর্কী আক্রমণ-পূর্ব বাংলাদেশে কবিতাকৃতির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন হল ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ (‘সুভাষিত রত্নকোষ’)। ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’-এর পুঁথি নেপালে পাওয়া যায়। নেওয়ালি অক্ষরে লিখিত এই খণ্ডিত পুথি সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন এফ. ডবলিউ. টমাস ১৯১২ সালে। পুঁথিটির প্রথম দিকের কিছু অংশ নষ্ট হওয়ায় এর প্রকৃত নাম কি ছিল তা জানা যায়নি। টীকার এক জায়গায় ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ এই শব্দগুলি আছে বলে টমাস সাহেব এই সমগ্র পুঁথিটিকে ঐ নামে চিহ্নিত করেন। তখনো মূল সংকলকের নাম ছিল অজ্ঞাত। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পূর্ণ গ্রন্থটি সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তাতে সংকলক ও সংকলনের নাম পাওয়া গেছে যথাক্রমে বিদ্যাধরএবং ‘সুভাষিত রত্নকোষ’। পুঁথিটির লিপি প্রাচীনতা দেখে স্থির করা হয়েছে যে, পুঁথিটির লিপিকাল ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের পরবর্তী নয়। তখন বঙ্গে পাল রাজত্ব চলছে। অনুমান করা হয় যে, সংকলক বিদ্যাধর বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন ; কারণ প্রথম দিকের শ্লোকে বুদ্ধবর্ণনা আছে।

‘সুভাষিত রত্নকোষ’ সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রথম সংকলিত শ্লোক কাব্য। এর আগে প্রকীর্ণ শ্লোক সংগ্রহের অনুরূপ উদ্যম আর দেখা যায়নি। আর এই প্রথম শ্লোককাব্য প্রায় আড়াই’শ জন কবির ১৭৩৮টি শ্লোক সংগৃহীত হয়েছে। এই কবিদের মধ্যে অনেকে বাঙালি ছিলেন বলে মনে করা হয়। সুতরাং এই সংকলনটিকে বাঙালির নিজস্ব সম্পদ বলে গ্রহণ করা যায়। অনেক কবি ছিলেন বাঙালি। যেমন- বসুকল্প, সঙ্ঘশ্রী, পুরুষোত্তম দেব, অভিনন্দ, মধুশীল, বীর্য মিত্র, বৈদ্য ধন্য, হিম্বোক, সিদ্ধোক প্রভৃতি বাঙালি ছিলেন বলে মনে করা হয়।

আরো পড়ুন--  রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় সাহিত্যচর্চা

কৃষ্ণের ব্রজলীলা দ্বাদশ শতকেও পূর্বেকার বাঙালির কতটা আদরণীয় ছিল, তার সুন্দর প্রমাণ পাওয়া যায় এই সংকলনে। অনেকগুলি হরি বিষয়ক কবিতা আছে। পরবর্তীকালে বৈষ্ণব পদাবলিতে যে লীলারস বর্ণিত হয়েছে, তার সুস্পষ্ট আভাস কয়েকটি কবিতায় রয়েছে। এই সংকলনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কবিতাই আদিরসাত্মক। এই সংগ্রহ থেকে সেকালের বাঙালির সাহিত্যিক রুচি সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানা যায়। বাঙালি একদিকে যেমন টুকরো টুকরো কবিতায় বাস্তবচিত্রণে কুশলতা অর্জন করেছিলেন, তেমনই আদিরসাত্মক কবিতার প্রতিও তার আসক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরবর্তীকালের ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ ও জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দে’ তার প্রমাণ আছে। এতে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা বিষয়ক অনেকগুলি শ্লোক সংযোজিত হয়েছে। বাংলাদেশের পরবর্তী সংস্কৃতির সঙ্গে এখানেই এর নাড়ীর যোগ রয়েছে। লক্ষ্মণসেনের রাজসভাকে কেন্দ্র করে যে আদিরসাত্মক ভক্তিবাদের ধারা প্রবাহিত হয়, তার উৎস এই ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ বা ‘সুভাষিত রত্নকোষ’-এর রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক শ্লোকের মধ্যে নিহিত।

সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘সংস্কৃত সাহিত্যে বাঙালির দান’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, ‘সুভাষিত রত্নকোষ’-এর অংশবিশেষ হল ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ নামক সংকলন গ্রন্থ। এই সংকলনের সম্পাদক এফ.ডবলিউ. টমাস সমগ্র পুঁথিকে ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ নামে অভিহিত করেছেন। এই গ্রন্থের সঙ্কলয়িতা কে তা জানা যায় না।তবে সঙ্কলয়িতা যে একজন বৌদ্ধ ছিলেন তার প্রমাণ হল এই গ্রন্থের প্রথম দুটি ‘ব্রজ্যা’য় বৌদ্ধ কবিতাগুলি সংগৃহীত হয়েছে। সম্ভবত কোন বাঙালি ছিলেন এর সংকলক; কারণ কবিতাসমষ্টির অনেকগুলো বাঙালি কবিদের (গৌড় অভিনন্দ, মধুশীল, শ্রীধর নন্দী) রচনা। গ্রন্থটিতে মোট ৫২৫টি কবিতা আছে। কবিরা কেউই একাদশ শতাব্দীর পরবর্তী নয়।  তাই খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতকের মধ্যে গ্রন্থখানি সংকলিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

আরো পড়ুন--  গাথাসপ্তশতী

গ্রন্থের কবিতাগুলি লিরিকধর্মী। বিভিন্ন ঋতুর বর্ণনা বেশ লাবণ্যময়। ‘হরিব্রজ্যায়’ উদ্ধৃত শ্লোকগুলিতে রাধা-কৃষ্ণ লীলার মধুর রসের পরিচয় পাওয়া যায়। এভাবে ‘ব্রজ্যা’ ক্রমে সংকলনের কবিতাগুলি সজ্জিত। প্রথমেই ‘সুগত ব্রজ্যা’। তারপর ‘লোকেশ্বর ব্রজ্যা’। তারপর ‘হরিব্রজ্যা’ ও ‘সূর্যব্রজ্যা’। এরপর ‘বসন্ত’, ‘মালিনী’, বিরহিণী’ প্রভৃতি ব্রজ্যা।

‘হরিব্রজ্যা’য় ২১ নং শ্লোকে রাধা কৃষ্ণের রহস্যমধুর চিত্রের পরিচয় রয়েছে। যেমন,

কোহয়ং দ্বারি হরিঃ প্রয়াহুপবনং শাখা মৃগেনাত্র কিং

কৃষোহহং দয়িতে বিভেমি সুতরাং কৃষ্ণ কথা বানরঃ ।

মু্গ্ধেহহং মধুসূদনো ব্রজ লতাং তামেব পুষ্পসবাম্‌

ইত্থং নির্বচনীকৃতো দয়িতয়া হ্রীণো হরিঃ পাতু বঃ।।

অনুবাদ : “দ্বারে কে ও? হরি। শাখামৃগের এখানে প্রয়োজন কি? উপবনে যাও। ওগো দয়িতে, আমি কৃষ্ণ। কৃষ্ণ! তবে তাকে আরও ভয় পাইতেছি। বানর কি কালো? ওগো মুক্ধে, আমি মধুসূদন। তাহা হইলে মধু পুষ্পলতার কাছে যাও। প্রিয়াদ্বারা এই প্রকারে নিরুত্তরীকৃত লজ্জিত হরি তোমাদিগকে রক্ষা করুন।” (জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী –  প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও বাঙালীর উত্তরাধিকার – দ্বিতীয় খণ্ড)

আরো পড়ুন--  চর্যাপদ-এর টীকাকার মুনিদত্ত [টীকা]

রাধাকৃষ্ণের লীলা বর্ণিত হয়েছে জয়দেবের গীতগােবিন্দে এবং পরবর্তীকালের বৈষ্ণব পদাবলীতে। আসলে কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ গৌড়ীয় রাধাকৃষ্ণ লীলার প্রাক্রূপ। বিরহিণী বা অসতীব্রজ্যায় যেসব লৌকিক প্রেমের কবিতা রয়েছে, তার প্রভাব পড়েছে বৈষ্ণব পদাবলীতে। রাধা কৃষ্ণের প্রেমের সূক্ষ্মতা ও সৌকুমার্য সম্পাদনে বৈষ্ণব পদকর্তাগণ ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় শ্লোক গুলোর কাছে ঋণী।

মিলনের ক্ষণকে দীর্ঘতর করবার জন্য ভাবী বিরহের আশঙ্কায় শঙ্কিতা নায়িকার কাতরোক্তি পরবর্তী বৈষ্ণব পদকর্তাদের প্রভাবিত করেছে। সুতরাং সংস্কৃত ভাষায় প্রকীর্ণ কবিতা রচনায় বাঙালি কবিকুল একাদশ শতকের আগেই যে সাবলীলতা অর্জন করেছিলেন, তার ঐতিহাসিক দলিল ‘সুভাষিত রত্নকোষ’।

 

 
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!