Menu

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮১২-১৮৫৯

Last Update : June 22, 2023

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮১২-১৮৫৯)

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ তথা ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পর তেমন কোন পালাবদলের ইঙ্গিত বাংলা কাব্যসাহিত্যে ফুটে ওঠেনি। ভারতচন্দ্রীয় আদিরসের ফেনিল উচ্ছ্বাস, আর কবিওয়ালাদের উচ্চকিত উল্লাস বাংলা সাহিত্যে শুধুমাত্র সামান্য পরিবর্তনের রেশ এনেছিল। তারপর রঙ্গলাল এসে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সর্বপ্রথম নতুন কাব্যবস্তুর নান্দীপাঠ করলেন। মধুসূদন নতুন নতুন কুশীলব নিয়ে শুরু করলেন তাঁর রচনা। সেই সময় বাংলা কাব্যে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিদায়ী মুহূর্তে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর পদধ্বনির মাঝে মধুসূদনের আবির্ভাবের ঠিক পূর্বে আবির্ভাব ঘটে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের। কবি একদিকে অতীতের পুরাতন সুর, অন্যদিকে অনাগত কালের পদধ্বনি এ দুইয়ের মাঝে দোলায়িত তাঁর দ্বন্দ্ব সংকুল কবি-মানস নিয়ে হয়েছেন আবির্ভূত। সেইজন্য তাঁকে ‘যুগসন্ধির কবি’ বলা হয়েছে। তিনি ছিলেন সাংবাদিক, কবি, সর্বোপরি পুরাতন কাব্য কবিতার ইতিহাস সংকলনের এক অন্যতম নায়ক।

‘যুগসন্ধি’ কথাটির অর্থ, প্রাচীন এবং নতুন যুগের ভাবধারা ও বিশ্বাসের একসঙ্গে প্রকাশের মহামুহূর্ত। এই অবস্থায় বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগ সমাপ্ত হয়েছে কিন্তু তার শেষটুকু তখনও সমাজে আছে। আধুনিক যুগ আরম্ভ হয়নি, শুধু তার আভাসমাত্র পাওয়া যাচ্ছে। নতুন সৃষ্টির চেষ্টা আছে, কিন্তু প্রতিভা নেই। আধুনিক ভাবের উন্মেষে এবং পুরনো ভাবধারার সংঘাতে অস্পষ্ট সেই আলো-আঁধারীর সময়কে ‘যুগসন্ধিকাল’ বলা হয়েছে। এই সময়কালে জন্ম হলে লেখকের ভাবনা এবং আচরণের মধ্যে পরস্পরবিরোধী চিন্তাভাবনা ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলার সংস্কৃতি ও কাব্যকবিতায় কবি ঈশ্বর গুপ্ত বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ‘সংবাদ প্রভাকরে’র সম্পাদক হিসেবেও তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ। এই সাময়িক পত্রে তাঁর রচনা ছিল বিশেষ উল্লেখ্য, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তাঁর প্রতিভার পরিচয় এতে মেলে। তিনি ছিলেন একাধারে সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক। যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভূত এই ‘কবি’ আপন সহজাত প্রতিভার গুণে কবিতা রচনা করে কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। তাঁর মধ্যে ছিল যুগসন্ধিক্ষণের কবির দ্বন্দ্ব, বেদনা, সংকট ও পারস্পরিক বিরোধিতা। তিনি নিজস্ব কবি প্রতিভার অধিকারী হওয়ায়, শিক্ষা সংস্কৃতিতে অনগ্রসর হয়েও একদা বাংলার কবিসমাজকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। দ্বারকানাথ অধিকারী, বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র, হরিমোহন সেন, মনোমোহন বসু, অক্ষয়কুমার দত্ত ও রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ পরবর্তীকালের ছোট বড় সাহিত্যিকগণ প্রায় সকলেই প্রথম যৌবনে গুপ্ত কবির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

image credit : wikipedia

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-এর জন্ম ও কর্মজীবন

ঈশ্বরগুপ্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন। (১৮১২ খ্রীঃ ৬ই মার্চ) ১২১৮ বঙ্গাব্দের ২৫-এ ফাল্গুন (মতান্তরে ১৮১১ খ্রীঃ, ৯ মার্চ, মৃত্যু ১৮৫৯ খ্রীঃ ২৪ জানুয়ারী, দ্রষ্টব্য : ‘সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী’, শিশির দাস, পৃষ্ঠা ৩৩) কাঁচরাপাড়ার এক সাধারণ বৈদ্যপরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যু হয় ১০ই মাঘ ১২৬৫। কবির পিতা হরিনারায়ণ গুপ্ত, মা শ্রীমতী দেবী। শৈশবে মাতৃবিয়োগ হওয়ায় তাঁর পিতা পুনরায় বিবাহ করেন। তিনি সেই অল্প বয়সেই কলিকাতায় দরিদ্র মাতামহের কাছে চলে আসেন। বাল্যে বা যৌবনে তিনি ইংরাজী, বাংলা, সংস্কৃত কোনটাই রীতিসম্মত উপায়ে অধ্যয়ন করেন নি।

অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে লালিত-পালিত হয়েও শুধু তীক্ষ্ণ প্রতিভার গুণে এবং স্বভাবসিদ্ধ প্রসন্ন পরিহাসের কল্যাণে তিনি কলিকাতার অভিজাত সমাজে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এই নিঃস্ব কবি তরুণ বয়সে ‘সংবাদ প্রভাকর’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করে অদ্ভূত মনোবলের পরিচয় দিয়েছিলেন, পরে তাঁর প্রচেষ্টায় এই পত্রিকাটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৈনিক পত্রিকায় পরিণত হয়। তিনি শিক্ষা-দীক্ষায় উচ্চতর জ্ঞানলাভ করতে না পারলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর নব নব আন্দোলনকে ঘৃণা করেন নি।

আরো পড়ুন--  কবি বিদ্যাপতির রচনাবলী | Discuss with Best Unique 11 Points

অনেকের ধারণা ঈশ্বর গুপ্ত প্রাচীনপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল, প্রগতি বিরোধী কবিওয়ালা শ্রেণীর কবি। একথা কিন্তু সত্য নয়। ঈশ্বর গুপ্তের মতো আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা-বর্জিত ব্যক্তি যে কি রকম প্রশংসনীয়ভাবে আধুনিক জীবনের কল্যাণের দিকটি গ্রহণ করেছিলেন, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। যদিও তিনি বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন, বিলাতী ধরনের নারীশিক্ষার সমর্থক ছিলেন না, ইয়ং বেঙ্গলদের উগ্রতাকে অত্যন্ত নিন্দা করতেন, সিপাহী বিদ্রোহকে বিদ্রূপ করে এবং ইংরেজের স্তুতিবাদ করে অনেক কবিতা লিখেছিলেন।

কিন্তু তা দিয়ে তাঁর প্রগতিবিরোধী মনোভাব প্রমাণিত হয় না, সেযুগের অনেকে উচ্চশিক্ষিত দেশনেতাও বিধবা বিবাহ সমর্থন করেন নি। সিপাহী বিদ্রোহকে সে যুগের অনেক উচ্চশিক্ষিত ভারতের স্বাদেশিক আন্দোলন বলে স্বীকার করতে পারেন নি। বাস্তবিক ঈশ্বর গুপ্ত কল্যাণকর আধুনিকতার বিরোধী ছিলেন না। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূচনা হলে তিনি সেই প্রস্তাব সানন্দে সমর্থন করেন ও বাংলাদেশে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত এই মর্মে ‘সংবাদ প্রভাকরে’ প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি স্ত্রী শিক্ষারও বিরোধী ছিলেন না। বরং পরিবারের মধ্যে স্ত্রীশিক্ষা প্রচারিত হলে বাঙালীর পারিবারিক সুখ ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে একথাও বলেছেন। আমাদের দেশে পাশ্চাত্যের ন্যায় কারিগরী বিদ্যালয় না থাকাতেও তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

ঈশ্বর গুপ্ত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যাপারেও বিস্ময়কর উদারতা দেখিয়েছেন। ইংরেজ সরকারের কর ধার্য করার নীতির বিরুদ্ধে তিনি তীব্র সমালোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে স্নেহ করতেন। তিনিও মহর্ষির উদার ব্রহ্মতত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনিই কবিতায় সর্বপ্রথম বাঙালীকে স্বদেশপ্রেমে দীক্ষা দিয়েছেন—দেশকে, ভাষাকে মাতৃরূপে বন্দনা করতে শিখিয়েছেন। তাই তাঁকে প্রগতিবিরোধী না বলে, প্রগতিশীল বলেই শ্রদ্ধা করা উচিত।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-এর রচনাসমূহ

ঈশ্বর গুপ্তের জীবৎকালে বিভিন্ন ধরনের রচনা প্রকাশিত হয়েছিল; যেমন—

(ক) কবিবর রামপ্রসাদ সেনের ‘কালীকীর্তন’ (১৮৩৩),

(খ) ‘কবিবর ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের জীবনবৃত্তান্ত’ (১৮৫৫),

(গ) ‘প্রবোধ প্রভাকর’ (১৮৫৮)।

তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘হিতপ্রভাকর’ (১৮৬১), ‘বোধেন্দুবিকাশ’ নাটক (১৮৬৩), ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’, ‘ভ্রমণকারী বন্ধুর পত্র’ (১৮৬৩) এবং বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় ঈশ্বর গুপ্তের ‘কবিতাবলী’ (১৮৮৫) প্রকাশিত হয়। কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন ঈশ্বর গ্রন্থাবলী (১৮৯৯) প্রকাশ করেন।

বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তে-এর অবদান

ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর গীতিকবিতা সংকলন’ গ্রন্থে ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যসমূহকে ছ’টি পর্যায়ে ভাগ করেছেন, যথা—(১) নৈতিক ও পারমার্থিক কবিতা, (২) সমাজ প্রীতিমূলক কবিতা, (৩) প্রেম-রসাত্মক কবিতা, (৪) তুচ্ছ বিষয়বস্তু অবলম্বনে কবিতা, (৫) সমসাময়িক বিষয় ও ঘটনা অবলম্বনে রচিত কবিতা, (৬) বিবিধ প্রসঙ্গে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা। এছাড়াও দু-একটি উপবিভাগ হতে পারে। এর দ্বারা অনুমান করা যায় গুপ্ত কবির রচনার প্রাচুর্য। তবে এই বিপুল রচনাসমূহের মধ্যে খুব কম লেখাই শেষ পর্যন্ত পদ্যের তরলতা ছাড়িয়ে কবিতা হতে পেরেছে।

ঈশ্বর গুপ্তের সাহিত্যকীর্তির সামগ্রিক অবদান স্মরণ করলে দেখা যায় তাঁকে নানা ভূমিকায়; যেমন—

(ক) তাঁর অকৃত্রিম দেশানুরাগ বা স্বদেশপ্রীতির ভাব অনুজ লেখকদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। তাঁর ভাবশিষ্য রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, দ্বারকানাথ অধিকারী, এমন কি বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যেও তার প্রকাশ দেখা গেছে। তাঁকে বাঙালীর ইতিহাস অন্বেষণে উৎসাহিত করেছিল।

আরো পড়ুন--  অশ্রুকণা ১৮৮৭ খ্রি

(খ) রঙ্গ-রসিকতা বা পরিহাসপ্রীতি—ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় হাস্যরসের প্রকাশ ঘটেছিল সমকালের সামাজিক বাস্তবতার পটভূমিতে। সেই হাস্যরসের প্রকাশ হয়ত সব সময় নির্মল ছিল না।

(গ) পত্রিকা সম্পাদনা—পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ববোধ বঙ্কিমচন্দ্র খুব সম্ভবত ঈশ্বর গুপ্তের কাছ থেকে শিখেছিলেন। ১৮৩১ খ্রীস্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারী যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুর ও প্রেমচাদ তর্কবাগীশের প্রচেষ্টায় এবং কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায় প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর‘[পড়ুন] প্রকাশিত হয়। এটি দেড় বছর পরে বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় ১৮৩৬ খ্রীস্টাব্দের ১০ আগস্ট নব কলেবরে প্রকাশিত হয়।

১৮৩৯ খ্রীস্টাব্দের ১৪ জুন এটি প্রথম বাংলা দৈনিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে (তথ্য-উৎস : ‘কলিকাতা তারিখ অভিধান’ দিব্যেন্দু সিংহ, ৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ২৪)। সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় লেখকগোষ্ঠী সৃষ্টির ঐতিহ্য বঙ্কিমচন্দ্র এবং তাঁর পরে অন্যান্য সম্পাদকেরাও ধারাবাহিক ভাবে অনুসরণ করেছিলেন। ফলে ঈশ্বর গুপ্তের অনুপ্রেরণাতেই এই পত্রিকা-কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত হয়েছিল বলে মনে হয়। ঈশ্বর গুপ্ত “সংবাদ প্রভাকর’ বাদে ‘পাষণ্ডপীড়ন’ (১৮৪৬), ‘সংবাদ রত্নাবলী’ (১৮৩২), ‘সংবাদ সাধুরঞ্জন’ (১৮৪৭) ইত্যাদি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন।

(ঘ) ঈশ্বর গুপ্ত বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিকের ভূমিকা প্রাথমিকভাবে পালন করেছিলেন। রামপ্রসাদ থেকে কবিওয়ালাদের পর্যন্ত জীবনী ও কবিতাসমূহ সংকলন করে ‘সংবাদ প্রভাকরে’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, “কবির প্রণীত কবিত্ব সকল গোপন থাকা কি দুঃখের বিষয়।” রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু সম্পর্কে তাঁর তথ্য-নির্ভর রচনা একালের চিত্রপরিচালকদেরও চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রেরণা দিয়েছে।

এইভাবে ঈশ্বর গুপ্ত একদিকে, ভারতচন্দ্রের ভাষাশিল্পের অনুসরণ, কবিওয়ালাদের মতো শ্লেষ-যমকের চমক এবং রজব্যঙ্গের ঝলক দেখিয়ে তাঁর কাব্যের বহিরঙ্গে প্রাচীন রীতি বজায় রেখেছেন। অন্যদিকে, বাংলা সাহিত্যে ও বাঙালী জীবনে জাতীয়তাবোধ ও বাস্তবতা সঞ্চার করে আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছেন। সেই কারণে তাঁকে নিঃসন্দেহে ‘যুগসন্ধির কবি‘ বলা যেতে পারে।

কাব্য সাহিত্য

ঈশ্বর গুপ্তের বিপুল সংখ্যক কবিতাকে আমরা প্রকৃতি, ঈশ্বরতত্ত্ব, নীতিতত্ত্ব, স্বদেশপ্রেম, নারীপ্রেম ও সমসাময়িক ঘটনা মোট এই ছয়ভাগে বিভক্ত করতে পারি। তাঁর নারীপ্রেম ও নীতি তত্ত্ব-বিষয়ক কবিতায় ভারতচন্দ্র ও কবিওয়ালাদের নিন্দনীয় প্রভাব সূচিত হয়েছে—যদিও এতে ভারতচন্দ্রের তীক্ষ্ণ বাগ্‌ভঙ্গিমার উজ্জ্বলতা নেই। তাঁর ঈশ্বরতত্ত্ব-বিষয়ক কবিতাগুলি ভক্তি ও নীতির বাঁধা পথেই রচিত। অবশ্য এতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ব্রহ্মতত্ত্বের প্রভাবই লক্ষ্য করা যায়।

তবে যে কবিতাগুলিতে হতাশকবির আতবেদনা ধ্বনিত হয়েছে, তিনি পুরাতন সংস্কার ছেড়ে আপনার মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন, সেখানে আন্তরিকতা ফুটে উঠেছে। তাঁর দেশপ্রেমের কবিতাগুলিতে (‘মাতৃভাষা’, ‘স্বদেশ’, ‘ভারত সন্তানের প্রতি’, ‘ভারতের অবস্থা’ ইত্যাদি) সর্বপ্রথম পরাধীনতার গ্লানি ও ভবিষ্যৎ ভারতের গৌরবময় চিত্র অঙ্কিত হয়েছে :

“কত রূপে স্নেহ করি দেশের কুকুর ধরি

বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।”

বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় :

“ঈশ্বর গুপ্তের ব্যঙ্গে কিছুমাত্র বিদ্বেষ নাই।…সবটাই রঙ্গ।”

কিংবা

“মাতৃসম মাতৃভাষা পুরালে তোমার আশা

তুমি তার সেবা কর মুখে।”

অবশ্য এই কবিতাগুলির জন্যই যে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন, তা ঠিক নয়। তিনি তদানীন্তন সমাজের পটভূমিকায় যে সমস্ত ব্যঙ্গবিদ্রূপমূলক কবিতা রচনা করেছিলেন, তার জন্যই তিনি বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন। মুখ্যত তিনি রঙ্গের কবি। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, “ঈশ্বর গুপ্তের ব্যঙ্গে তৎকালীন সমাজের নানা অনাচার ও বিশৃঙ্খলাকে তিনি পরিহাসের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। এই রঙ্গব্যঙ্গে উতরোল কবিতাগুলিতেই তাঁর প্রতিভা যথার্থ বিকাশের পথ খুঁজে পেয়েছে।” বিলাতী মহিলা সম্বন্ধে উক্তি :

“বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ছুটে,

আহা তায় রোজ রোজ কত ‘রোজ’ ফুটে।”

ফিরিঙ্গি শিক্ষায় উদ্ধত বাঙালী মেয়ের প্রতি বিদ্রূপ :

“যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে

কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে

তখন এ. বি. শিখে বিবি সেজে

বিলাতী বোল করেই কবে।”

ইয়ং বেঙ্গলদের প্রতি ক্রুদ্ধ ধিক্কার :

“সোনার বাঙাল করে কাঙাল ইয়ং বাঙাল যত জনা।’

অথবা,

“যত কালের যুবো যেন সুবো

ইংরাজী কয় বাঁকা ভাবে;

ধোরে গুরুপুরুত মারে জুতো

ভিথারী কি অন্ন পাবে?”

তেমনি কৌলীন্য প্রথাকেও তিনি বিদ্রূপ করেন এই বলে :

“পোকাধরা শৌকা ভার কুলের আচার।

এ দেশের কুলধর্ম করগো সংহার ॥”

এই সমস্ত হাস্যপরিহাস-মিশ্রিত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ পরম উপভোগ্য। জীবনের লঘু দিকটি তাঁর কোন কোন কবিতায় (‘পাঠা’, ‘আনারস’, ‘তপসে মাছ’, ‘বড়দিন’ ইত্যাদি) আশ্চর্য তীক্ষ্ণতা লাভ করেছে। জীবনের প্রতি তাত্ত্বিক বা আদর্শনিষ্ঠ আকর্ষণ নয়, সহজ রসের প্রসন্নতা তাঁর এই কবিতাগুলিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। তাঁর কোন কোন উক্তি (যেমন—”এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা”; “শয্যায় ভার্যার প্রায় ছারপোকা উঠে গায়”, “বিবিজান চলে যান লবে-জান করে”) এখনও জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত।

আরো পড়ুন--  কবি জ্ঞানদাস, 16শ শতকের কবি

সূক্ষ্ম কারুকার্য, কল্পনা কুশলতা, আবেগ বা অন্য কোন মহৎ কবিত্বশক্তি না থাকলেও দৈনন্দিন জীবনের রঙ্গরসমুখর এরূপ চিত্ররূপ তাঁর পূর্বে আর কারো মধ্যে দেখা যায় না। ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের মন্তব্যটি মূল্যবান : “যাহা আছে, ঈশ্বর গুপ্ত তাহার কবি। তিনি এই বাঙ্গালী সমাজের কবি। তিনি কলিকাতা শহরের কবি। তিনি বাঙ্গলার গ্রাম্য দেশের কবি।” সম্ভবতঃ সেইজন্য বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রথম জীবনের কবিতাচর্চায় ঈশ্বর গুপ্তের অনুসরণ করেছিলেন। কথিত আছে ঈশ্বর গুপ্ত ‘প্রায় পঞ্চাশ হাজার ছত্র’ কবিতা লিখেছিলেন। এছাড়া ‘প্রবোধ প্রভাকর’ ও ‘বোধেন্দুবিকাশ’ নাটকেও তাঁর লেখা পদ আছে। কবিতা সম্পর্কে তাঁর বোধের উন্মেষ ঘটেছে হয়ত এই অভিজ্ঞতা-সূত্রেই :

“পটুয়ার চিত্র ক্রমে রূপান্তর হয়।

কবি চিত্র কিবা চিত্র বিকাশের নয় ৷”

ঈশ্বর গুপ্তের গদ্যরচনার গুরুত্বও অপরিসীম, তাঁর গদ্য প্রথম গদ্য-লিখিয়েদের প্রভাবে প্রস্তুত নয়, তাঁর নিজেরই মতে; স্ববিহিত অলঙ্কৃত সংস্কৃত রীতির আড়ম্বর এবং কথ্যগুণ দুইয়ের মিশ্রণ আছে। সমালোচকদের মধ্যে অবশ্য এই গদ্যরীতির সম্পর্কে বিরূপতার ভাবই প্রকট। যেমন রমেশচন্দ্র দত্তের মতে, “artificial and alternative and somewhat grotesque” তবু ঈশ্বর গুপ্তের গদ্যের প্রণিধানযোগ্য অংশ হল, আটপৌরে শব্দসম্ভার এবং বাঙালীর লৌকিক সংলাপ রীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া।

সর্বোপরি বলা যায়, ঈশ্বর গুপ্তের ব্যক্তিত্ব তথা তাঁর সারস্বত সাধনার মধ্যে দ্বিমানসিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন কবিতায় তিনি প্রথানুগত, সংরক্ষণশীল, নব্যশিক্ষা, সংস্কৃতি আন্দোলন ও পাশ্চাত্য ভাবধারাগুলি তাঁর ব্যঙ্গের বিষয়, অথচ সেই নব্য বঙ্গীয়দের আয়ুধ স্বরূপ টম্ পেইন (Age of Reason) অংশতঃ অনুবাদ করে ‘সংবাদ প্রভাকরে’ প্রচার করেছিলেন (দ্রষ্টব্য : ভবতোষ দত্ত সম্পাদিত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত কবিজীবনী)। এই দ্বৈত মনোবৃত্তির কারণে সেকাল ও একাল এ দুয়ের উপরেই তাঁর তুল্য আকর্ষণ লক্ষিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!