Menu

উজ্জ্বলনীলমণি, শ্রীরূপ গোস্বামী

Last Update : April 26, 2024

উজ্জ্বলনীলমণি, শ্রীরূপ গোস্বামী


শ্রীরূপ গোস্বামীর লিখিত সাহিত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন হল ‘উজ্জ্বলনীলমণি’। বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীদের মধ্যে জ্ঞানী ও ভক্ত রূপ গোস্বামী তাঁর এই গ্রন্থে বৈষ্ণব রসতত্ত্বের নানান দিক আলোচনা করেছেন— যা বৈষ্ণব সমাজে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

‘উজ্জ্বলনীলমণি’-তে পাঁচটি মুখ্যরসের প্রধানতম যে রস শৃঙ্গার, মধুর বা উজ্জ্বল রস – তাকে অধ্যাত্ম ব্যঞ্জনার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’-তে বৈষ্ণব ভক্তির স্থায়িভাব যে কৃষ্ণরতি তা নিয়ে আলোচনা  করেছেন। কিন্তু উজ্জ্বলনীলমণি-তে মূলত উজ্জ্বল বা মধুর রসের বিস্তৃত আলোচনা করেছেন—যা গৌড়ীয় বৈষ্ণব রসশাস্ত্র সম্মত।

রূপ গোস্বামী মূলত সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রসম্মত শৃঙ্গার রসের-ই বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। উজ্জ্বল রসের স্থায়ীভাব হল ‘প্রিয়তা’ বা ‘মধুরারতি’। কৃষ্ণগোপীর শৃঙ্গার সম্ভোগলীলায় এই রসের পূর্ণতা। শৃঙ্গার রতিকে ‘ভক্তিরসরাজ’ বলা হয়। এই গ্রন্থে নায়িকাদের সকলকেই কৃষ্ণবল্লভা বলা হয়েছে। গোপীদের মধ্যে বৃন্দাবনের রাসরসেশ্বরী সর্বশ্রেষ্ঠা—রূপ গোস্বামীর মতে শ্রীরাধা কৃষ্ণের হ্লাদিনী মহাশক্তি।

আরো পড়ুন--  সোমপ্রকাশ পত্রিকা 1858

মধুরা রতির সাতটি পর্যায় চিহ্নিত করেছেন শ্রীরূপ গোস্বামী। এগুলি হল—প্রেম, স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ এবং ভাব বা মহাভাব। শ্রীরূপ গোস্বামী প্রেমের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন,

সর্বথা ধ্বংসরহিতং সত্যপি ধ্বংসকারণে।

যদ্ভাববন্ধনং যূনোঃ স প্রেমা পরিকীর্তিতঃ।।

অর্থাৎ ধ্বংসের কারণ থাকলেও যুবক-যুবতীর মধ্যে যে ভাব ধ্বংস হয় না সেই ভাববন্ধন কে প্রেম বলে। ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে’ কবিরাজ গোস্বামী মধুরারতির এই সাতটি পর্যায়কে শ্রীরূপ গোস্বামীর অনুকূলে ব্যাখ্যা করেছেন।

প্রিয়তমের কাছে থেকেও প্রেমাধিক্যবশত যে বিচ্ছেদবুদ্ধিজনিত আর্তি, তাকে প্রেমবৈচিত্ত্য বলেছেন –

প্রিয়স্য সন্নিকর্ষেহপি প্রেমোৎকর্ষ-স্বভাবতঃ।

যা বিশ্লেষধিয়ার্তিস্তৎ প্রেমবৈচিত্র্যমুচ্যতে।।

রূপ গোস্বামী চেয়েছিলেন আদিরসকে অপ্রাকৃত বিভাবনার মাধ্যমে উজ্জ্বল করে তুলবেন—যা ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থ রচনার প্রধান উদ্দেশ্য। এই গ্রন্থে নায়ক কৃষ্ণের নানা বৈচিত্র্য এবং নায়িকা কৃষ্ণপ্রিয়াদের স্বকীয়-পরকীয়াদি নানা ভেদ পনেরটি প্রকরণে নিপুণভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে।

আরো পড়ুন--  বারমাস্যা বা বারমাসী

উজ্জ্বলনীলমণি-তে পনেরটি প্রকরণ আছে। নায়কভেদ, নায়ক সহায়কভেদ, শ্রীকৃষ্ণবল্লভা, শ্রীরাধা, নায়িকাভেদ, যুথেশ্বরীভেদ, দূতীভেদ, সখীভেদ, শ্রীহরি বল্লভা, উদ্দীপন বিভাব, অনুভাব, সাত্ত্বিক ভাব, ব্যভিচারী ভাব, স্থায়ীভাবে এবং শৃঙ্গারভেদ প্রকরণ।

এই গ্রন্থ ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে বৈষ্ণব সাহিত্যকে পরিপুষ্ট করেছিল। বিশ্বনাথ চক্রবর্তী এই গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশ করে নাম দিয়েছিলেন ‘ভক্তিরসামৃত সিন্ধু বিন্দু’। শ্রীজীব গোস্বামী এই গ্রন্থের টীকা রচনা করেছিলেন এবং সেই গ্রন্থের নাম ‘লোচনরচনী’। বৈষ্ণবীয় রসশাস্ত্রের এটি একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ – যা চৈতন্যদেবের প্রয়াণের পর রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থের দ্বারা বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শন পূর্ণতা লাভ করেছিল।

সংযোজন ১ : সুকুমার সেন


অপর বড় রচনার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বৈষ্ণব-রসশাস্ত্রের বই দুখানি ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ ও ‘উজ্জ্বলনীলমণি’। রূপ ইহাতে কৃষ্ণলীলা ভাবনাকে সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের রসাভিব্যক্তির পথে প্রবাহিত করিয়া দিলেন। পরবর্তী কালে যাঁহারা প্রায় সকলেই গীতিকবিতায় অথবা গেয় ও পাঠ্য কবিতায় কৃষ্ণলীলা বর্ণনা করিয়াছেন তাঁহারা প্রায় সকলেই বিশেষ করিয়া উজ্জ্বলনীলমণির অল্পবিস্তর অনুশীলন করিয়াছিলেন। …

আরো পড়ুন--   কাশীদাসী মহাভারত 

উজ্জ্বলনীলমণি রচনায় হাত দিবার অনেক আগেই চৈতন্য অপ্রকট হইয়াছিলেন। বোধ করি সম্ভবত বন্দনায় চৈতন্যের নাম ধরিয়া উল্লেখ নাই, গুরুর নামের শেষে উল্লিখিত। তখন ঘনিষ্ট পরিচয় হয় নাই বলিয়াই বইটির আরম্ভ গৌড়েই হইয়াছিল। [বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড]

সংযোজন ২ : অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়


‘উজ্জ্বলনীলমণি’ প্রধানত অলংকারশাস্ত্র ও রসতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত। এতেও তিনি কৃষ্ণরতিকেই মুখ্য স্থান দিয়ে তার আলোকে রসতত্ত্ব ও অলংকার তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। বৈষ্ণবসাহিত্যের দিঙ্‌নির্দেশক এই ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ পরবরতীকালে সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যের ওপর যে অভূতপূর্ব প্রভাব বিস্তার করেছিল, ভারতীয় সাহিত্যের কোনো অলংকারশাস্ত্রের ভাগ্যেই সে রকম অসপত্ন গৌরবলাভ ঘটেনি [বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত]

বইয়ের PDF ডাউনলোড করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!