Last Update : December 24, 2021
কবি কৃত্তিবাসের সময়কাল
কবি কৃত্তিবাসের আত্মবিবরণ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত “সেকাল” কবিতায় লিখেছিলেন:
“হায়রে কবে কেটে গেছে কালিদাসের কালপণ্ডিতেরা বিবাদ করে লয়ে তারিখ সাল।”
কৃত্তিবাসের কবি-মহিমা স্মরণ করে একথা পাঠকেরও মনে হতে পারে। রামায়ণ পাঁচালীর অমর কবি কৃত্তিবাস যথার্থই বাংলা দেশের ‘কীর্তিবাস’। কিন্তু রাজমহল থেকে চট্টগ্রাম এবং উড়িষ্যার উপকূল থেকে কামরূপ পর্যন্ত ভূভাগের আবালবৃদ্ধবনিতার চিত্তপটে ভাগীরথী ধারার মত যিনি প্রবাহিত করেছেন রামকথামৃত, তার সম্বন্ধে নিঃসংশয় তথ্য আজও অজ্ঞাত। অবশ্য তার আত্মপরিচয়ে অনেক দুর্লভ তথ্য উদ্ঘাটিত ৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা বহু মতভেদের কণ্টকে আকীর্ণ। নিজের জন্মসন কবি এইভাবে উল্লেখ করেছেন :
“আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ মাঘ মাস।তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস ॥”
নানা বিতর্কের ফলে অবশেষে প্রামাণ্য বলে স্বীকৃত হয়েছে গবেষক সুখময় মুখোপাধ্যায়ের মতামত। তিনি ১৩৮৯ খ্রীস্টাব্দের ৩রা জানুয়ারি (মাঘমাস, রবিবার শ্রীপঞ্চমীর দিন) কৃত্তিবাসের জন্মদিন বলে সিদ্ধান্ত করেছেন। আবার অন্যান্য সমালোচকশ্রেণী (ড. সুকুমার সেন ও ড. ভূদেব চৌধুরী প্রমুখ) ১৩৯৯ খ্রীস্টাব্দকে কৃত্তিবাসের জন্মসন বলে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রাম কবির শৈশব কৈশোরের স্মৃতি-বিজরিত জন্মভূমি। কবির পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝা পূর্ববঙ্গ থেকে এখানে এসে স্থিতিলাভ করেছিলেন। তাঁরই প্রপৌত্র বনমালী কৃত্তিবাসের পিতা। মাতা মালিনীর গর্ভে ছয় পুত্রের জন্ম হয়:
“মালিনী নামেতে মাতা বাবা বনমালী।ছয় ভাই উপজিল সংসারে গুণশালী ॥”
বারো বছর বয়সে পদ্মা নদী অতিক্রম করে কৃত্তিবাস চতুষ্পাঠীতে উপনীত হন। রাজপণ্ডিত হওয়ার ধ্রুব আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য যৌবনে তিনি গৌড়েশ্বরের সভায় উপস্থিত হন:
“রাজপণ্ডিত হব মনে আশা করে।পঞ্চশ্লোক ভেটিলাম রাজা গৌড়েশ্বরে ॥”
নিজের পাণ্ডিত্য ও কবিত্ব শক্তিতে রাজাকে মুগ্ধ করে তিনি রাজ-অনুগ্রহ ও পুরস্কার লাভে সক্ষম হন। এইভাবে রাজকবির আসন অলঙ্কৃত করে তিনি “শ্রীরামপাঁচালী” শেষ করেন।
কৃত্তিবাস যে প্রখ্যাত পণ্ডিত একথা তাঁর আত্মবিবরণীতে একাধিকবার উল্লিখিত হয়েছে :
“কৃত্তিবাস পণ্ডিত মুরারী ওঝার নাতি।যার কণ্ঠে সদা কেলি করেন ভারতী ॥ ”
রাজদ্বারে স্থায়ী আসনলাভের পর তাঁর কবিত্ব ও পাণ্ডিত্য কিভাবে সমাদৃত হয়েছিল তার বিশ্বস্ত আলেখ্য আত্মজীবনীতে পরিস্ফুট :
“পঞ্চদেব অধিষ্ঠান আমার শরীরে।সরস্বতী প্রসাদে শ্লোক মুখে হৈতে স্ফুরে ॥
নানা ছন্দে শ্লোক আমি পড়িনু সভায়। শ্লোক শুনি গৌড়েশ্বর আমা পানে চায় ।
চন্দনে ভূষিত আমি লোক অনিন্দিত।সবে বলে ধন্য ধন্য ফুলিয়া পণ্ডিত ৷৷মুনি মধ্যে বাখান বাল্মীকি মহামুনি।পণ্ডিতের মধ্যে কৃত্তিবাস গুণী ॥”
এই ‘আত্মবিবরণ’ অংশ পাঠ করে মনে হয়, মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে সম্ভবতঃ কৃত্তিবাসের মধ্যেই প্রথম এই ‘আত্মগৌরব’ বোধ দেখা দিয়েছিল :
“কারো কিছু নাহি লই করি পরিহার।যথা যাই তথায় গৌরবমাত্র সার ॥”
শ্রীচৈতন্যদেবের জন্ম ১৪৮৬ খ্রীস্টাব্দে আর কৃত্তিবাসের জন্ম ১৩৯৯ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে। কৃত্তিবাস যে গৌড়েশ্বরের সভায় দেখা দেন, তার পরিবেশ ও পাত্র-মিত্রাদির বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয়, এই ‘গৌড়েশ্বর’ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। ইতিহাস বলে, তুর্কী বিজয়ের পর বাংলাদেশে যে একমাত্র হিন্দুরাজা গৌড়েশ্বরের মর্যাদায় ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত, তিনি হিন্দুরাজা গণেশ। ১৪১৪ থেকে ১৪১৮ খ্রীস্টাব্দ তার রাজত্বকাল বলে নির্ণীত।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের ‘উত্তরা খণ্ডের’ একটি পুঁথি লিপির সমাপ্তিকাল ১৫০২ শকাব্দ। তা দেখে ড. সুকুমার সেনের অনুমান যে, কৃত্তিবাসের মূল গ্রন্থটি ঐ সময়ের পূর্বে রচিত। কৃত্তিবাস প্রাচীন কবি, তার নিঃসংশয় নিদর্শন— জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল কাব্য’। সেখানে কৃত্তিবাস, চণ্ডীদাস ও গুণরাজ খান—এই তিন কবির নামোল্লেখ বিদ্যমান। জয়ানন্দ ষোড়শ শতকের মধ্যভাগের কবি। সুতরাং ঐ কবিত্রয় যে অদ্ভুত পঞ্চাশ বছর পূর্বের সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। কৃত্তিবাস চৈতন্যপূর্ব না চৈতন্যপরবর্তী সে সম্বন্ধে তর্কজাল আজও সৃজিত। বুও অধিকাংশ বিদগ্ধ গবেষকের সুচিস্তিত অভিমত, কৃত্তিবাস চৈতন্যপূর্ববর্তী কবি।