Last Update : May 24, 2024
‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’, ‘ভারতপথিক’ ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত হয়ে থাকেন রাজা রামমোহন রায়। ভারত ইতিহাসের নবজাগরণ পর্বের শুকতারা রামমোহন রায়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বাংলা সাহিত্যের সঙ্গেও সংপৃক্ত হয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যে তাঁর কৃতিত্ব কতখানি সেই বিষয়ক ক্ষুদ্র একটি আলোচনা।
বাংলা সাহিত্যে রামমোহন রায় 1774-1833 খ্রি.
পাণ্ডিত্য, ব্যক্তিত্ব এবং কর্মক্ষমতার সার্থক সমন্বয় হয়েছে রামমোহনের চরিত্রে। সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি, উর্দু ও বাংলা এই ক’টি ভাষায় ছিল তাঁর গভীর জ্ঞান। মূল বাইবেল পড়বার জন্য তিনি প্রাচীন হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন। কর্মযোগী রামমোহনের চেষ্টাই সতীদাহ প্রথা নিবারণের প্রধান কারণ। খ্রিস্টান মিশনারীদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তিনি এদেশে খ্রিস্টধর্মের অগ্রগতি রুদ্ধ করেন। ঔপনিষদিক হিন্দু ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করে ব্রাহ্মধর্মের প্রচলনও তাঁরই কীর্তি। প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতি পরিহার করে আধুনিক ইউরোপীয় শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণের পক্ষে মত প্রকাশ করে তিনি মধ্যযুগের বন্ধন থেকে দেশবাসীর মনের মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং জাতীয় স্বাধীনতার স্পষ্ট চেতনাও তাঁর মধ্যে প্রথম অঙ্কুরিত হতে দেখি। তিনি বেদান্ত দর্শনের বিশুদ্ধ জ্ঞানযোগ এবং সমাজ-সংস্কার-শিক্ষাসংস্কার কেন্দ্রিক কর্মযোগকে সমন্বিত করেছিলেন। ধর্ম ও দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি ভারতের প্রাচীন আদর্শের পক্ষপাতী, আবার শিক্ষা ও সমাজাদর্শের দিক তিন থেকে তিনি পাশ্চাত্য ভাবনার ভাবুক। রামমোহনের জীবন ও কর্মে– তাঁর মুক্তবুদ্ধি যুক্তিবাদে বিশ্বাস, সুগভীর মানবতাবাদ, প্রাচীন শাস্ত্রাদি উদ্ধারের চেষ্টা সব কিছু মিলিয়ে নবজাগৃতির পূর্ণরূপ প্রতিবিম্বিত।
রামমোহন রায়-এর সাময়িক পত্র পরিচালনা
রামমোহনের ‘সম্বাদ কৌমুদী’ নামক পত্রিকা ১৮২১ সালে প্রকাশিত হয়। শ্রীরামপুর মিশন প্রচারিত সাময়িক পত্রিকায় হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে রচনা প্রচারিত হতে দেখে তিনি তাঁর পত্রিকায় তীব্র প্রতিবাদ করতে থাকেন। এছাড়াও নানাবিধ সারগর্ভ প্রবন্ধে এই সাপ্তাহিক পত্রিকার কলেবর পূর্ণ থাকত। রামমোহন রায় একটি ইংরেজি এবং একটি ফারসি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন।
প্রাবন্ধিক রামমোহন রায়
রামমোহন কয়েকখানা উপনিষদের অনুবাদ করেন (১৮১৫ – ১৯)। বেদান্ত সম্বন্ধে তাঁর অন্য দুখানা গ্রন্থও প্রকাশিত হয়– ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ ও ‘বেদান্তসার’ (১৮১৫)। এই দুটি গ্রন্থে রামমোহন নানাদিক থেকে বেদান্ত মতের বিচার করেছেন। তিনি এর মধ্য দিয়ে একেশ্বরবাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। দুই খণ্ডে ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ’ (১৮১৮ এবং ১৮১৯) এবং ‘গৌডীয় ব্যাকরণ’ (১৮৩৩) তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সহমরণ প্রথা নিবারণের যৌক্তিকতা নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন প্রথমোক্ত গ্রছে। এ ছাড়া তাঁর বিতর্কমূলক কয়েকখানি গ্রন্থেরও নাম করা উচিত। যেমন, ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ (১৮১৭), ‘গোস্বামীর সহিত বিচার’ (১৮১৮), ‘পথ্যপ্রদান’ (১৮২৯) , ‘কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার’ প্রভৃতি।
রামমোহন প্রায় ত্ৰিশখানা বাংলা গ্রন্থ রচনা করেন, এ ছাড়া বহু ইংরেজি ও সংস্কৃত গ্রন্থেরও তিনি রচয়িতা। রামমোহনের ব্যক্তিত্বের যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে তাঁর রচনাবলীর মধ্যে তারই প্রতিফলন । লক্ষ করা যায় তাঁর প্রবন্ধ-গ্রন্থাবলী চিন্তার স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্তের মৌলিকতা যেমন ধরে রেখেছে তেমনি রামমোহনের সমগ্র ব্যক্তিত্বকেও যেন প্রকাশ করেছে। তিনি ধর্মে প্রাচ্যের ভাবানুগামী হলেও সামাজিক ও ব্যক্তিগত আচার, শিক্ষাগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রনীতি মতবাদে পাশ্চাত্যানুসারী ; জ্ঞানমার্গী বৈদান্তিক হয়েও বিষয়কর্মে সু-অভিজ্ঞ।
রামমোহন রায়-এর ভাষারীতি
রামমোহনের হাতে বাংলা গদ্যভাষা প্রথম আভিজাত্য লাভ করল। এর পূর্বে স্কুল-কলেজে পাঠ্য করবার জন্যই গদ্যে নানাবিধ পশুপক্ষীর কাহিনি, ভূগোল-পরিচয় বা বালসেব্য সেকালীন উপকথা সঙ্কলিত হত। রামমোহন বাংলা শিশুগদ্যে বেদান্ত-উপনিষদের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা আরম্ভ করেন। প্রাচীন শাস্ত্রের প্রমাণে এবং যুক্তির প্রবলতায়, তীক্ষ্ণ বিতর্কে তাঁর গদ্য এক কঠিন পৌরুষ লাভ করল। বাংলা গদ্যে যে গুরুগম্ভীর আলোচনা সম্ভব তিনিই প্রথম তা দেখিয়ে দিলেন। ফলে বাংলা শিশুগদ্য কিছু নুয়ে পড়ল, পদচারণায় কিছু স্খলন এবং অস্বাচ্ছন্দ্য দেখা দিল। দুরূহ বিষয়বস্তুর আলোচনার সম্ভাবনা রামমোহনের পূর্বে কেউ দেখতে পাননি। তাই রামমোহনের গদ্য যে সরল ছিল না এজন্য তাকে অভিযুক্ত করা চলে না। তবে পরবর্তী অনেকের তুলনায় তিনি ভাষাকে জড়ত্ব ও অকারণ কাঠিন্য থেকে অনেকটা মুক্ত করেছিলেন।
সব দিক দিয়ে বিচার করলে রামমোহন রায়কে বাংলা ভাষার প্রথম প্রাবন্ধিক (চিন্তা প্রধান প্রবন্ধের রচয়িতা) বলে অবশ্যই অভিহিত করা যায়।
রামমোহনের রচনা থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করলে তাঁর ভাষার পৌরুষ এবং যুক্তিপ্রাণতার পরিচয় যেমন মিলবে তেমনি দেখা যাবে পদবিন্যাসের ক্ষেত্রেও তিনি বাংলা ভাষার স্বরূপ ধর্মকে অনেকখানি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। রামমোহন খ্রিস্টীয় মিশনারীদের ধর্মপ্রচারের বিরুদ্ধাচরণ করে লিখেছেন,
শতার্দ্ধ বৎসর হইতে অধিক কাল এ-দেশে ইংরেজের অধিকার হইয়াছে তাহাতে প্রথম ত্রিশ বৎসরে তাহাদের বাক্যের ও ব্যবহারের দ্বারা ইহা সর্ব্বত্র বিখ্যাত ছিল যে কাহারো ধর্মের সহিত বিপক্ষতাচারণ করেন না…. কিন্তু ইদানীন্তন বিশ বৎসর হইল কতক ব্যক্তি ইংরেজ যাহারা মিশনারী নামে বিখ্যাত হিন্দু ও মোছলমানকে ব্যক্তরূপে তাঁহাদের ধর্ম হইতে প্রচ্যুত করিয়া খ্রীষ্টান করিবার যত্ন নানা প্রকারে করিতেছেন।… যদ্যপিও যিশুখ্রীষ্টের শিষ্যেরা সধৰ্ম সংস্থাপনের নিমিত্ত নানা দেশে আপন ধর্মের উৎকর্যের উপদেশ করিয়াছেন কিন্তু ইহা জানা কর্তব্য যে সে সকল দেশ তাহাদের অধিকারে ছিল না সেইরূপ মিশনারীরা ইংরেজের অনধিকারের রাজ্যে যেমন তুরকি ও পারসিয়া প্রভৃতি দেশে যাহা ইংলণ্ডের নিকট হয় এরূপ ধৰ্ম উপদেশ ও পুস্তক প্রদান যদি করেন তবে ধর্মার্থে নির্ভয় ও আপন আচার্যের যথার্থ অনুগামীরূপে প্রসিদ্ধ হইতে পারেন……
কমা, সেমিকোলন প্রভৃতি উপযুক্ত বিরাম চিহ্ন দিয়ে পড়লে বোঝা যায় যে ভাষার পদবিন্যাসরীতি রামমোহন অনেকটা আয়ত্ত করেছিলেন।
রামমোহন রায় সংক্রান্ত একটি ঐতিহাসিক সমস্যা
রামমোহন রায়কে “বাংলা গদ্যের জনক” বলে অনেকে অভিহিত করে থাকেন। এই অভিমতের যাথার্থ্য বিচার করা দরকার। বাংলা সাহিত্যিক গদ্যের ভিত্তি স্থাপনে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতদের দান অবশ্যস্বীকার্য। এঁরা সকলেই রামমোহনের পূর্ববর্তী। এঁদের অনেকের তুলনায় রামমোহনের ভাষারীতি উন্নত। বিষয়বস্তুর গাম্ভীর্য ও গৌরবের দিক থেকে অবশ্য রামমোহন পূর্ববর্তী এবং সমকালীন গদ্যলেখকদের অনেকটা ছাড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার তাঁর বহু পূর্বেই বাংলা গদ্যকে সাহিত্যরূপ দেবার চেষ্টা করেছেন। সাধু ও চলিত ভাষা নিয়ে তিনি পরীক্ষা করেছেন। তাঁর গদ্য রামমোহন রায়ের তুলনায় অগ্রবর্তী। সমকালীন লেখকদের মধ্যে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নকশাগুলিতেও কিছু সাহিত্যগুণ-সমন্বিত গদ্য ব্যবহার করেছেন। রামমোহনের গদ্যের একটি প্রধান ত্রুটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী,
তাঁহার অবলম্বিত রীতি যে বঙ্গ সাহিত্যে গ্রাহ্য হয় নাই তাহার প্রধান কারণ, তিনি সংস্কৃত শাস্ত্রের ভাষ্যকারদিগের রচনা পদ্ধতি অনুসরণ করিয়াছিলেন। এ গদ্য, আমরা যাহাকে modern prose বলি, তাহা নয়। পদে পদে পূর্বপক্ষকে প্রদক্ষিণ করিয়া অগ্রসর হওয়া আধুনিক গদ্যের প্রকৃতি নয়।’
রামমোহনের গদ্যের আর একটা বড় দুর্বলতা হল ইংরেজি কমপ্লেক্স বাক্যের অনুসরণে বাংলা বাক্যের কাঠামো গড়ে তোলা।
তাই রামমোহনকে বাংলা গদ্যের উল্লেখযোগ্য লেখক এবং প্রথম প্রাবন্ধিক বলে অভিনন্দিত করলেও, জনক বলে অভিহিত করা চলে না।
সাহায্য : ক্ষেত্রগুপ্ত