Last Updated on December 24, 2021 by বাংলা গাইড
রামমোহন রায় (১৭৭৪ – ১৮৩৩ খ্রি.)
পাণ্ডিত্য, ব্যক্তিত্ব এবং কর্মক্ষমতার সার্থক সমন্বয় হয়েছে রামমোহনের চরিত্রে। সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি, উর্দু ও বাংলা এই ক’টি ভাষায় ছিল তাঁর গভীর জ্ঞান। মূল বাইবেল পড়বার জন্য তিনি প্রাচীন হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন। কর্মযোগী রামমোহনের চেষ্টাই সতীদাহ প্রথা নিবারণের প্রধান কারণ। খ্রিস্টান মিশনারীদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তিনি এদেশে খ্রিস্টধর্মের অগ্রগতি রুদ্ধ করেন। ঔপনিষদিক হিন্দু ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করে ব্রাহ্মধর্মের প্রচলনও তাঁরই কীর্তি। প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতি পরিহার করে আধুনিক ইউরোপীয় শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণের পক্ষে মত প্রকাশ করে তিনি মধ্যযুগের বন্ধন থেকে দেশবাসীর মনের মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং জাতীয় স্বাধীনতার স্পষ্ট চেতনাও তাঁর মধ্যে প্রথম অঙ্কুরিত হতে দেখি। তিনি বেদান্ত দর্শনের বিশুদ্ধ জ্ঞানযোগ এবং সমাজ-সংস্কার-শিক্ষাসংস্কার কেন্দ্রিক কর্মযোগকে সমন্বিত করেছিলেন। ধর্ম ও দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি ভারতের প্রাচীন আদর্শের পক্ষপাতী, আবার শিক্ষা ও সমাজাদর্শের দিক তিন থেকে তিনি পাশ্চাত্য ভাবনার ভাবুক। রামমোহনের জীবন ও কর্মে— তাঁর মুক্তবুদ্ধি যুক্তিবাদে বিশ্বাস, সুগভীর মানবতাবাদ, প্রাচীন শাস্ত্রাদি উদ্ধারের চেষ্টা সব কিছু মিলিয়ে নবজাগৃতির পূর্ণরূপ প্রতিবিম্বিত।
সাময়িক পত্র পরিচালনা
রামমোহনের ‘সম্বাদ কৌমুদী’ নামক পত্রিকা ১৮২১ সালে প্রকাশিত হয়। শ্রীরামপুর মিশন প্রচারিত সাময়িক পত্রিকায় হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে রচনা প্রচারিত হতে দেখে তিনি তাঁর পত্রিকায় তীব্র প্রতিবাদ করতে থাকেন। এছাড়াও নানাবিধ সারগর্ভ প্রবন্ধে এই সাপ্তাহিক পত্রিকার কলেবর পূর্ণ থাকত। রামমোহন রায় একটি ইংরেজি এবং একটি ফারসি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন।
প্রাবন্ধিক রামমোহন
রামমোহন কয়েকখানা উপনিষদের অনুবাদ করেন (১৮১৫ – ১৯)। বেদান্ত সম্বন্ধে তাঁর অন্য দুখানা গ্রন্থও প্রকাশিত হয়— ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ ও ‘বেদান্তসার’ (১৮১৫)। এই দুটি গ্রন্থে রামমোহন নানাদিক থেকে বেদান্ত মতের বিচার করেছেন। তিনি এর মধ্য দিয়ে একেশ্বরবাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। দুই খণ্ডে ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ’ (১৮১৮ এবং ১৮১৯) এবং ‘গৌডীয় ব্যাকরণ’ (১৮৩৩) তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সহমরণ প্রথা নিবারণের যৌক্তিকতা নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন প্রথমোক্ত গ্রছে। এ ছাড়া তাঁর বিতর্কমূলক কয়েকখানি গ্রন্থেরও নাম করা উচিত। যেমন, ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ (১৮১৭), ‘গোস্বামীর সহিত বিচার’ (১৮১৮), ‘পথ্যপ্রদান’ (১৮২৯) , ‘কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার’ প্রভৃতি।
ভাষারীতি
শতার্দ্ধ বৎসর হইতে অধিক কাল এ-দেশে ইংরেজের অধিকার হইয়াছে তাহাতে প্রথম ত্রিশ বৎসরে তাহাদের বাক্যের ও ব্যবহারের দ্বারা ইহা সর্ব্বত্র বিখ্যাত ছিল যে কাহারো ধর্মের সহিত বিপক্ষতাচারণ করেন না…. কিন্তু ইদানীন্তন বিশ বৎসর হইল কতক ব্যক্তি ইংরেজ যাহারা মিশনারী নামে বিখ্যাত হিন্দু ও মোছলমানকে ব্যক্তরূপে তাঁহাদের ধর্ম হইতে প্রচ্যুত করিয়া খ্রীষ্টান করিবার যত্ন নানা প্রকারে করিতেছেন।… যদ্যপিও যিশুখ্রীষ্টের শিষ্যেরা সধৰ্ম সংস্থাপনের নিমিত্ত নানা দেশে আপন ধর্মের উৎকর্যের উপদেশ করিয়াছেন কিন্তু ইহা জানা কর্তব্য যে সে সকল দেশ তাহাদের অধিকারে ছিল না সেইরূপ মিশনারীরা ইংরেজের অনধিকারের রাজ্যে যেমন তুরকি ও পারসিয়া প্রভৃতি দেশে যাহা ইংলণ্ডের নিকট হয় এরূপ ধৰ্ম উপদেশ ও পুস্তক প্রদান যদি করেন তবে ধর্মার্থে নির্ভয় ও আপন আচার্যের যথার্থ অনুগামীরূপে প্রসিদ্ধ হইতে পারেন……
একটি ঐতিহাসিক সমস্যা
তাঁহার অবলম্বিত রীতি যে বঙ্গ সাহিত্যে গ্রাহ্য হয় নাই তাহার প্রধান কারণ, তিনি সংস্কৃত শাস্ত্রের ভাষ্যকারদিগের রচনা পদ্ধতি অনুসরণ করিয়াছিলেন। এ গদ্য, আমরা যাহাকে modern prose বলি, তাহা নয়। পদে পদে পূর্বপক্ষকে প্রদক্ষিণ করিয়া অগ্রসর হওয়া আধুনিক গদ্যের প্রকৃতি নয়।‘
তাই রামমোহনকে বাংলা গদ্যের উল্লেখযোগ্য লেখক এবং প্রথম প্রাবন্ধিক বলে অভিনন্দিত করলেও, জনক বলে অভিহিত করা চলে না।