Last Updated on January 15, 2022 by বাংলা গাইড
গঙ্গারামের মহারাষ্ট্রপুরাণ
চৈতন্যচরিত সাহিত্যে তথ্যাশ্রয়ী যুগ-বীক্ষণের সূচনা হয়। কাব্যের মধ্যে সমকালীন ইতিহাসের প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল তবু তা পূর্ণরূপ নয় পদক্ষেপ, পূর্ণাঙ্গ, কাহিনীর আশ্রয়ে নয়, অনুসঙ্গী ও সহায়িকার রূপে তা স্থান পায়। সেই রূঢ় বাস্তবের তাপ ও ইতিহাসের উত্তাপ পূর্ণভাবে পাওয়া গেল যে-গ্রন্থে, তার নাম ‘মহারাষ্ট্রপুরাণ’ বা ‘ভাস্কর পরাভব’, বিষয়—মারাঠা অধিপতি সাহু (রঘুজী ভৌসলা) সহচর ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বুকে বর্গীসেনার ভয়াবহ অত্যাচার বর্ণনা। কবির নাম, গঙ্গারাম বা গঙ্গানারায়ণ দেব।
আবিষ্কার
বাংলা ১৩১১ বঙ্গাব্দে মৈমনসিংহের কৃষিশিল্প প্রদর্শনীতে ‘সৌরভ’ সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদার এই কাব্যের পুঁথি সম্পর্কে প্রথম পরিচয় দেন। তারপর দেন ব্যোমকেশ মুস্তাফী। কেদারনাথের প্রদত্ত তথ্য থেকে জানা যায়, অষ্টাদশ শতকের প্রারম্ভে কিশোরগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ধরীশ্বর গ্রামে কবির জন্ম হয়। তাঁর কৌলিক উপাধি দের (প্রপিতামহের নাম হরিশ্বর দেব), কিন্তু জঙ্গলবাড়ীর মুসলমান জমিদারের সেরেস্তার উচ্চপদাধিকারী কর্মচারীরূপে উপাধি পান ‘চৌধুরী’। পরে জমিদারের সঙ্গে মতান্তরের জন্য কাজ ত্যাগ করেন। কিন্তু ব্যোমকেশ মুস্তাফীর মতে, কবি গঙ্গারাম রাঢ়বাসী। অন্যদিকে অধ্যাপক রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যশোহর নড়াইলের এক অখ্যাত কবি গঙ্গারাম দত্তকে মহারাষ্ট্রপুরাণের রচয়িতারূপে স্বীকৃতদানে উৎসুক হন। কিন্তু যথেষ্ট যুক্তির অভাবে এঁদের কারোরই দাবী অভ্রান্তভাবে প্রমাণিত হয়নি।
রচনাকাল
কাব্যটির একটি অন্যতম বিশেষত্ব, গ্রন্থের রচনাকাল নির্দেশে রচয়িতার স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন মনোভঙ্গি—
বৈশাখের উনিশায় বর্গী আইলা তায়
মহা আনন্দিত হৈয়া মনে।
১৭৫১ খ্রীস্টাব্দে ১৯শে বৈশাখ (১১৪৯ বঙ্গাব্দ)—“ইতি মহারাষ্ট্রপুরাণে প্রথম কাণ্ডে ভাস্করপরাভব শকাব্দ ১৬৭২ সন ১১৫৮ সাল তারিখ ১৪ই পৌষ রোজ শনিবার” (ক বি. পুথি) অর্থাৎ এই কাব্য ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়। বাংলাদেশে বর্গীর উৎপাতের সময়সীমা ১৭৪২ থেকে ১৭৪৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত; অভিযান হয় তিনবার–১৭৪২, ১৭৪৩, ১৭৪৪ খ্রীস্টাব্দ। বাংলাদেশের মসনদে তখন অধিষ্ঠিত হৃতসম্বল সুলতান আলিবর্দি। অপমানিত ও লাঞ্ছিত সুলতান দেওয়ান জানকীরাম ও সিপাহশালার মুস্তাফা খাঁর সহযোগিতায় সুকৌশলে নিরস্ত্র অবস্থায় ভাস্কর পণ্ডিত ও তাঁর অনুচরদের ডেকে এনে গুপ্তভাবে হত্যা করেন।
কাব্যটির প্রথম কাণ্ডের নাম ‘ভাস্কর পরাভব’। পুথিগত সাক্ষ্যের অভাবে অন্য কাণ্ড আর লেখা হয়নি বলেই অনুমান। কাহিনীর বহিরঙ্গে পুরাণের ছদ্মবেশে—পৃথিবীতে অবিচার অত্যাচার দেখে ক্লিষ্টা পৃথিবীকে সঙ্গে করে ব্রহ্মার শিবের কাছে আগমন হয়। শিবের নির্দেশে তাঁর অনুচর নন্দী মারাঠা-রাজ সাথকে অত্যাচার দমনে আদেশ দেন (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলেও পাওয়া যায়, অনুরূপ বিবরণ)। কিন্তু অনুচর ভাস্কর পণ্ডিতের বর্গী (বা বার্গীর) সেনাদলের ব্রাহ্মণ ও নারীদের উপর নৃশংস অত্যাচার দেখে দেবী পার্বতী ভৈরবীদের নির্দেশ দেন—”ভাস্করকে বাম হইয়া নবাবকে সদয় হবি”।
রচনার উদ্দেশ্য বর্গীদের অত্যাচার বর্ণনা
‘মহারাষ্ট্রপুরাণে’র মুখ্য লক্ষ্য হল ইতিহাস বর্ণনা। ঘুমন্ত ব্রতকথার মতো শান্ত পল্লীবাংলার জনমানসে বর্গীর নামে নেমেছিল আতঙ্কের ধস্, গ্রামে-গঞ্জে-কুটিরে জ্বলে উঠেছিল যে অত্যাচারের দাবানল, ছড়াকারদের রচনায় ছড়িয়েছিল যার রেশ—তাকেই কবির সমকালের ঐতিহাসিকের মতো দায়িত্ব নিয়ে অনুপুঙ্খ তথ্যচেতনায় এবং নির্লিপ্ত-ভঙ্গীতে প্রকাশ করেন।
ভাল ভাল স্ত্রীলোক যত ধইরা লইয়া যাএ
অঙ্গুষ্ঠে দড়ি বেঁধে দেয় তার গলাএ।
একজনে ছাড়ে তারে অন্যজনা ধরে।
রমণের ডরে ত্রাহি শব্দ করে।।
এই যদি হয় নারী-নিগ্রহের বিবরণ, তবে অন্যের ক্ষেত্রে,
কাহুকে বাঁধে বরগী দিআ পিঠমোড়া।
চিত কইরা মারে লাথি পাত্র জুতা চড়া।।
এই বর্ণনার ভঙ্গী গদ্যাত্মক, ওড়িয়া কবি ব্রজনাথ বড়জেনার ‘সমরতরঙ্গ’এর মতো কাব্যিক নয়। তবু এ বিবরণের উৎস যে রাজকর্মচারী গঙ্গারামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাজনিত ফলশ্রুতি, তা কোন ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। একথা ঠিক, কাব্যরসিকের আগ্রহ এ গ্রন্থ মেটায় না, একালের সতর্ক ইতিহাস পাঠকও দু-একটি তথ্যচ্যুতি হয়ত খুঁজে পাবেন, তবু মহারাষ্ট্রপুরাণে’র প্রত্যক্ষদ্রষ্টা স্রষ্টাকে সাধুবাদ জানাতে হয়।