Menu

কল্লোল পত্রিকা 1923

Last Update : April 28, 2024

কল্লোল পত্রিকা
কল্লোল পত্রিকা

কল্লোল পত্রিকা ১৯২৩ 1923

শুরুর কথা

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের পর্যালোচনা করতে গেলে দেখা যায় যে, এক একটি সাময়িক পত্র-পত্রিকা চিন্তা সৃষ্টি ও ভাবনার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে সাহিত্যের ক্রমবিকাশে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা দান করেছে। রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক যুগ নামে একটি যুগ সাহিত্যের ইতিহাসে সুচিহ্নিত হয়ে আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কালে বাঙালির চিন্তামনন ও সৃষ্টিরাজ্যে একটা আমূল পরিবর্তন আসে। জীবন সম্পর্কে পূর্বের ধ্রুব বিশ্বাস ও আদর্শনিষ্ঠার অবক্ষয় ঘটে আর্থ-সামাজিক কারণে।

বাংলাদেশের ইতিহাস যুদ্ধ পরবর্তী প্রায় দু’দশকব্যাকী ভাঙনের ইতিহাস – তরুণ-সমাজের তখন অর্থনৈতিক স্থিতি নেই-সংশয়, হতাশা, দৈন্য, নীতিহীনতা তারুণ্য শক্তিকে গ্রাস করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম বার বার বিপর্যস্ত হচ্ছে ব্রিটিশের ধূর্ত বুদ্ধির চক্রান্ত ও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে। যাঁরা সাহিত্যচর্চা করছেন তাঁদের কাছে এল পাশ্চাত্যের আধুনিক কাব্যের জনক T. S. Eliot-এর Waste Land & Hollomen- এর বার্তা। জমির শস্য পুড়ে গেছে-কিছু নেই-চারদিকে শূন্যতার অগ্নিবলয়। হতাশা থেকে আসে নিঃসঙ্গতা ও নৈরাজ্য।

বাঙালি তরুণ লেখকরা ভাবলেন জীবনটা ভাঙাচোরা-এর কোনো উদ্দেশ্য নেই। সংশয়, নৈরাশ্য, একাকীত্বের জীবন নিরর্থক। এ জীবনের কখন পূর্ণচ্ছেদ ঘটবে ঠিক নেই। তাই দেউলিয়া জীবন ঝুঁকে পড়ল সেক্স-এর দিকে। যতদিন পারো যেমন করে বাঁচো, যৌনজীবন ভোগ করে নাও। এর স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকা মানে মানবজীবন অসার্থক, ব্যর্থ। এইসব হল পশ্চিমি দুনিয়ার নেতিবাচক জীবনচেতনা। পাশ্চাত্যের এই ভাবধারার ধারক ও বাহক ছিল ১৯২৩ সালে প্রকাশিত ‘কল্লোল’ পত্রিকা। এর সহযোগী শাখা হিসেবে বেরোয় ‘কালি ও কলম’ এবং ‘প্রগতি’।

সাধারণভাবে এই মত সুপ্রচলিত যে কল্লোলের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল – বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার প্রতিষ্ঠায় কল্লোলের অবদান অস্বীকার করা যায় না। অনেকের মতে কল্লোল সাহিত্যে পশ্চিমি ভাবাদর্শের উত্তপ্ত হওয়া বইয়েছিল বটে; কিন্তু সাহিত্যে কল্লোল যুগ বলে কিছু নেই। কল্লোলে আকর্ষণ করার মতো উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। অন্যান্য পত্রিকার মতো ‘খাড়া-বড়ি-থোড় থোড়-বড়ি-খাড়া’ ছাড়া আর কিছু নয়। কল্লোলে কোলাহল ধ্বনি সৃষ্টি হয়-কিন্তু কোলাহলে কোনো আদর্শ থাকে না। শুধু sex, বস্তিজীবন, নিষিদ্ধ প্রেমের কাহিনি ও যৌনতায় কল্লোলের পৃষ্ঠা ছিল পিচ্ছিল।

আরো পড়ুন--  উজ্জ্বলনীলমণি, শ্রীরূপ গোস্বামী

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত কল্লোলের লেখক ছিলেন। তিনি ‘কল্লোল যুগ’ নামে একটি বই লিখেছেন। আলোচনায় প্রতিপন্ন করতে প্রয়াসী হয়েছেন ‘কল্লোল’ পত্রিকা স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে সংস্কারমুক্ত বলিষ্ঠ জীবনাদর্শের উজ্জীবন ঘটিয়ে বহু সাহিত্যিকের প্রতিভা বিকাশে সাহায্য করেছে। কল্লোলের মতো পত্রিকা ‘ন ভূতো ন ভবিষ্যতি’। অবশ্য এ উক্তি অতিশয়োক্তি। কল্লোলের ঐতিহাসিক ভূমিকা আমরা অস্বীকার করি না, কিন্তু কল্লোল, বঙ্গদর্শন ও সবুজপত্রের মতো ঐতিহ্যবাহী যুগান্তকারী ভাবাদর্শের ধারক ও বাহক ছিল না। লেখকরা পশ্চিমি উত্তেজনায় গা ভাসিয়েছেন বেশি, দেশীয় জীবনের সমাজধর্ম ও সংস্কৃতির অন্তর্দৃষ্টি ছিল না।

কল্লোল প্রতিভাশালীদের লালন করেছে, নতুন প্রতিভা সৃষ্টি করতে পারেনি। আধুনিকতা বাংলা সাহিত্যে এসেছে যুগধর্মের স্বাভাবিক প্রবর্তনায়। সেক্ষেত্রে কল্লোলের যা ভূমিকা তা সামান্য-কল্লোল এক নিজস্ব লেখকগোষ্ঠী তৈরি করেছে। কিছু লেখা প্রকাশ করেছে। সাত বছরের আয়ুষ্কালের কল্লোল কোনো ইতিহাস সৃষ্টির মর্যাদা পাবে কিনা তা যথেষ্ট বিতর্কের ব্যাপার।

কল্লোল পত্রিকা’র ইতিহাসে ফোর আর্টস ক্লাব

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আরম্ভেরও আরম্ভ থাকে। প্রদীপ জ্বালাবার আগে সলতে পাকাতে হয়। ‘কল্লোল’-পত্রিকার উৎস ‘ফোর আর্টস ক্লাব’। নারী পুরুষ সদস্য নিয়ে গোকুলচন্দ্র নাগ ও দীনেশরঞ্জন দাশের অভীপ্সায় সাহিত্য, সংগীত, চিত্রশিল্প ও কারুশিল্প চর্চার জন্য ‘ফোর আর্টস ক্লাব’ গড়ে ওঠে। গোকুল, দীনেশের সঙ্গে যোগ দেন সুনীতি দেবী, সতীপ্রসাদ সেন। পরে সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সাহিত্য বিভাগে খ্যাত-অখ্যাত অনেক সাহিত্যিক যোগ দেন। অধিবেশন ছিল মার্জিত শিল্পরুচিসম্মত।

শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশায় সদস্যদের চালচলন অনিবার্য ক্লেদ জমিয়ে তুলল। রক্ষণশীল পরিবার নৈতিক অবক্ষয় ও নৈরাজ্যের জন্য প্রখর সমালোচনায় সোচ্চার হল। ১৯২১-১৯২২ দু’বছর এই ক্লাবের আয়ুষ্কাল। এই ক্লাব নির্বাধ জীবনচর্যা, যৌবনবন্দনা ও চিন্তা অনুভুতির উষ্মা প্রবাহে নব্যরুচির মৌসুমি হাওয়া তুলে বিলীন হয়ে যায়। এই ক্লাবের মৃত্যুর পরে সেই যৌবন ফিরে আসে নবরূপে ‘কল্লোল’ পত্রিকায়।

কল্লোল পত্রিকা’র লেখকগোষ্ঠী

‘কল্লোল’ পত্রিকা ১৩৩০ সালের ১ বৈশাখ প্রকাশিত হয়। সাত বছর এটি টিকে ছিল। তারপর নানা কারণে বিশেষত অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়। যুগচিন্তার অনিবার্য পরিণতি হিসাবে কল্লোল বিদ্রোহের জয়ধ্বজা উড়িয়ে চলে। কল্লোল প্রথমে শুধু মাসিক গল্পপত্রিকা হিসাবে প্রকাশিত হলেও, পরে এতে কবিতা ও অনুবাদসাহিত্য এবং শেষে প্রবন্ধও স্থান পায়। একান্নজন কবি বিভিন্ন সময়ে এতে লেখেন। তাঁদের মধ্যে নজরুল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, রবীন্দ্রনাথ, অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, জসিমউদ্দিন, নরেন্দ্র দেব, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, অজিতকুমার দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচি, প্রিয়ম্বদা দেবী, হুমায়ুন কবির, জীবনানন্দ দাস, বিষ্ণু দে, অন্নদাশঙ্কর, বন্দেআলি মিঞা ও মনোজ বসুর নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া গানও ছাপা হত।

আরো পড়ুন--  তুর্কি আক্রমণ, বাংলা সাহিত্যে তার প্রভাব

মৌলিক গল্প ও উপন্যাস এবং অনূদিত গল্প উপন্যাসের লেখক হিসাবে পাই প্রবোধকুমার সান্যাল, প্রমথনাথ বিশী, শিবরাম চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নরেন্দ্র দেব, মনীশ ঘটক, জগদীশ গুপ্ত, জলধর সেন, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ লেখক। ১৩৫ জন কথাসাহিত্যের লেখক কল্লোলে লেখেন। অনূদিত গল্পলেখক ছিলেন নয়জন। পাঁচজন লেখকের নাটক ও একাঙ্কিকা ছাপা হয়। পরে প্রবন্ধও ছাপা হয়। প্রমথ চৌধুরী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, দিলীপকুমার রায়, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায়, অমলেন্দু বসু, বিপিনচন্দ্র পাল, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর গদ্য প্রবন্ধ লেখেন। লেখক-লেখিকার রচনার ভাব বা বিষয়বস্তু পাঠকদের কাছে সহজভাবে তুলে ধরার জন্য ‘পরিচয়লিপি’ বিভাগ থাকত কল্লোলে। আরও থাকত-পুস্তক পরিচয় ও নানা কথা।

কল্লোল পত্রিকা’র মূল্যায়ন

‘কল্লোল’ পত্রিকা প্রসঙ্গে মোহিতলাল-নজরুল বিরোধ ও ‘শনিবারের চিঠি’-‘কল্লোল’ বিরোধ তুঙ্গে উঠে। শনিবারের চিঠি সাহিত্যের শুচিতা রক্ষার জন্য কোমর বেঁধে ব্যঙ্গবিদ্রুপের বাণ নিক্ষেপ করতে থাকে। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারডি ‘ব্যাঙ’ ছাপা হয় শনিবারের চিঠিতে। নজরুল মনে করেন সেটি মোহিতলালের লেখা। এ নিয়ে ব্যঙ্গের চাপান-উতোরে প্যারডি লেখা হয়। সাহিত্যে আধুনিকতা নিয়ে বিরোধ বিদ্রূপ তুঙ্গে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের মধ্যস্থতায় বিচিত্রা ভবনে দু-দুবার এর বৈঠক বসে।

রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার নামে সেক্স- এর বেআব্রুতার লালসা ও মিথুনাসত্তির বিরোধী ছিলেন। সাহিত্যে অভব্য বিষয় ও লেখকের মানসিক অসুস্থতার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ক্ষুন্ন হন। তিনি আধুনিক সাহিত্যকে বিষয়ের দিক থেকে অস্বীকার করে সাহিত্যের নবরূপকে গুরুত্ব দিলেন। আধুনিকতা রূপ নিয়ে, বিষয় নিয়ে নয়। কবির বক্তব্য ছিল আধুনিকতা বা রিয়ালিজম ফুটবে রচনার জাদুতে। অর্থাৎ বাস্তবের ভাঙাচোরা জীবন, নৈরাশ্য, অবসাদ, বিষন্নতাকে জীবধর্মী করে তুলতে হবে। সেক্ষেত্রে বে-আব্রতা কখনো কাম্য নয়।

আরো পড়ুন--  সদুক্তিকর্ণামৃত - শ্রীধর দাস

সাহিত্যের প্রকৃত স্বরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টিতে ও সাময়িকতার উত্তরণে শাশ্বত সৌন্দর্য সৃষ্টিতে। কিছু না-মানা ও অমঙ্গল চেতনায় নীচে তলিয়ে যাওয়ার প্রবণতা মানে জীবনের ব্যভিচার ও মানবধর্মের বিনষ্টি। উলঙ্গ প্যাশনবৃত্তিতে আধুনিকতা হবার নয়। কিন্তু এই মধ্যপন্থী সিন্ধান্তে কোনো পক্ষই খুশি হননি। এ সময় তিনি একাধিক রচনায়, প্রবন্ধে মন্তব্য করেন-সাহিত্যে বেআব্রুতা নিত্যপদার্থ নয়, ল্যাঙট-পরা গুলি-পাকানো ধুলোমাখা রচনা আধুনিক নয়, সাহিত্যের রসের হোলিখেলায় কাদামাখামাখি কাম্য নয়, পাশ্চাত্যের রিয়ালিজমের বাঁধাবুলির অনুসরণ করে অপটু লেখকেরা রিয়ালিটির ‘কারি পাউডার’ তৈরি করছে। দারিদ্র্যের আস্ফালন ও লালসার অসংযম ব্যাপারটা সাহিত্যে ‘সত্যমূল্য না দিয়ে’ খ্যাতি চুরি করা।

"সত্যমূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি,

ভালো নয় ভালো নয়, নকল সে সৌখীন মজদুরী।"

আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত ছিলেন না। তরুণ সাহিত্যিকদের অভ্যর্থনায় তিনি ছিলেন মুক্তমনা ও উদার। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তিনি তথাকথিত আধুনিক কাব্যকে পশ্চিমের ভাবধারার নকল করা রচনা মনে করতেন। ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যভাবনা ও আধুনিক বাংলা সাহিত্য’ সম্পর্কে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-এর দ্বিতীয় পর্বে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে।

‘বনফুল’ কল্লোল যুগকে ‘কল্লোলের হুজুগ’ বলেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতে কল্লোলের পিছনে কোনো চিরায়ত সংস্কৃতি ছিল না। তা সত্ত্বেও কল্লোল চিত্ত-প্রবৃত্তির সত্যতা ও শক্তির জয়পতাকা উড্ডীন করেন। তাঁদের কাছে প্রবৃত্তি ছিল স্বভাবজ-তা সুন্দর ও নির্মল। প্রেম, নারীপুরুষের দেহমন নিয়ে। জননীর সন্তান স্নেহও প্রেম। আর নরনারীর কাম, দেহলালসা এবং দেহভোগও প্রেম। কাম সম্পর্কে তাঁরা পুরাতন সংস্কার ও ধ্যানধারণা ভেঙে দিয়ে বিপুল এক আলোড়ন তোলেন তরুণ সমাজে। তার ঐতিহাসিক মূল্য অস্বীকার করা যায় না।


পত্রপত্রিকা সম্পর্কিত অন্যান্য লেখা


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!