Menu

মিশনারীদের প্রচেষ্টায় বাংলা গদ্য

Last Update : January 15, 2022

 

পোর্তুগীজ মিশন

 
ইউরোপীয় জাতিগুলির মধ্যে পর্তুগীজদের সঙ্গেই বাংলাদেশের প্রথম সম্পর্ক স্থাপিত হয়। খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে গিয়ে তারা বাংলা ভাষা শিখে বাংলায় বই লেখা প্রয়োজনীয় বলে বোধ করতে লাগলেন। সপ্তদশ শতকেই যে এ জাতীয় গদ্য রচনার আবির্ভাব ঘটেছিল তার পরোক্ষ প্রমাণ আছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত কিছু বই পাওয়া গিয়েছে।
 
১. দোম আন্তোনিও রচিত ‘ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’। লেখক বাঙালি জমিদারপুত্র। মগ দস্যুদের দ্বারা অপহৃত হলেপোর্তুগীজ পাদরিরা তাকে কিনে নেয় ও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দান করে। এই পুস্তিকাটি প্রশ্নোত্তর আকারে লেখা। খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম্য এতে প্রচার করা হয়েছে। ঢাকার অঞ্চল-বিশেষের কথ্যরীতির প্রভাবে এই ভাষা গড়ে উঠেছিল।
 
২. মনো-এল-দ্য আসসুম্পসাও-এর গ্রন্থ ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’  (রচনাকাল ১৭৩৪)। অনেক গবেষকের মতে এই গ্রন্থের বাংলা অংশের অনুবাদ অসসুম্পসাম দেশীয় খ্রিস্টানদের দিয়ে করিয়েছিলেন। ভাষার নমুনা—

সেই বনের নজদিক এক শহর আছিল। সেই শহরে অনেক বেপারি বেপার করিত একদিন একটা বেপারি জিনিস কিনিয়া আপনের দেশে যাইতে চাহিল। আর বেপারির ঠায় কহিত এহি দেশে অনেক ডাকাইত আছেএ কারণে আমারে বিদাএ দিও।

উপযুক্ত বিরামচিহ্ন বসিয়ে এ ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এ ভাষায় ফারসি শব্দের ব্যবহার আছে। ঢাকার অঞ্চল-বিশেষের কথ্যরীতির প্রভাবও লক্ষ করা যায়।
 
৩. মনো-এল একখানি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ এবং পোর্তুগিজ বাংলা শব্দককোষও রচনা করেন।
পরবর্তী বাংলা গদ্যে পোর্তুগিজ মিশনের কোন স্থায়ী প্রভাব রক্ষিত হয়নি। অবশ্য অঞ্চল-বিশেষের কথ্যরীতি আদর্শরূপে গৃহীত হওয়ায় এ ভাষা একান্ত দুর্বোধ্য নয়। প্রথম দিকের লেখ্য গদ্যের পক্ষে এ কম গৌরবের কথা নয়। এদেশের ভাষার প্রতি ইউরোপীয়দের আগ্রহের সূচনা এঁদের মধ্যে। এঁরাই কেরী-মার্শম্যানের পূর্বসূরী।
 

ইংরেজ শাসক ও শ্রীরামপুর মিশন

 
এদেশে রাষ্ট্রাধিকার স্থাপিত হওয়ায় ইংরেজ শাসকবর্গ দেশীয় ভাষার প্রতি কিছুটা আকৃষ্ট হল। ইংরেজদের বাংলা শেখার জন্য। ন্যাথানিয়াল ব্রাসি হ্যালহেড অষ্টাদশ শতকে একটি বাংলা ব্যাকরণ বই লিখলেন (১৭৭৮) ইংরেজিতে ‘A Grammar of the Bengali Language’ । এই শতাব্দীতেই কিছু কিছু আইনের বঙ্গানুবাদ করা হল। ফরস্টার ‘কর্ণওয়ালিশ কোডে’র অনুবাদ করলেন। একটি শব্দকোষও তৈরি করেছিলেন তিনি। বলা বাহুল্য সে ভাষা অত্যন্ত জড়। 



কিন্তু এঁরা বাংলা সাহিত্যের সর্বাপেক্ষা উপকার করলেন মুদ্রণ যন্ত্র স্থাপন করে। মুদ্রাযন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিপ্লব হবার পূর্বে আমাদের দেশে হাতে লেখা পুথি প্রচলিত ছিল। তুলট কাগজতালপাতা বা ভূজ পাতায় এই সব পুথি লিখিত হত। যাদের প্রয়োজন তাঁরা নকল করিয়ে নিত। তখন অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন লোকের সংখ্যা বেশি ছিল না। কথকতা-কীর্তন পাঁচালি গানের মারফত তখনকার সাহিত্য লোকের কাছে পৌঁছত। কিন্তু গদ্য সাহিত্য ঐ ভাবে প্রচারিত হতে পারে না। স্কুল কলেজের পাঠ্য বই মুদ্রিত হওয়া দরকারঅনেক শিক্ষিত লোক থাকলে বহুসংখ্যক মুদ্রিত পুস্তক ছাড়া তাঁদের জ্ঞান-তৃষ্ণা নিবারণ করা যায় না । মুদ্রাযন্ত্র একসঙ্গে অনায়াসে বহুসংখ্যক গ্রন্থ প্রস্তুত করে। নকলকারেরা ইচ্ছামত মূল বইয়ের পরিবর্তন করতমুদ্রিত বইয়ের পরিবর্তন অসম্ভব। নানা কারণেই মুদ্রাযন্ত্রের স্থাপনা যে কোনো সাহিত্যের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য ইংরেজ কর্তৃপক্ষ মুদ্রাযন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। হ্যালহেডের ব্যাকরণ বইটি এদেশে মুদ্রিত হল। উইলকিনস বাংলা হরফ তৈরি করে দিলেন। শ্রীরামপুরের পঞ্চানন কর্মকার তাঁর কাছ থেকে হরফ তৈরি শিখে কলকাতায় একটি কারখানা বসালেন।

আরো পড়ুন--  সবুজ পত্র ১৯১৪
 
এদিকে ইংরেজ মিশনারীরা কেরির নেতৃত্বে শ্রীরামপুরে আসর জমালেন। এক পুরানো মুদ্রাযন্ত্র ইংল্যান্ড থেকে আনিয়েপঞ্চানন কর্মকারের কাছ থেকে বাংলা অক্ষর জোগাড় করে শ্রীরামপুরে প্রেস বসানো হল। শ্রীরামপুর প্রেস এবং মিশন বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছে।
 
কেরিটমাসওয়ার্ডমার্শম্যান প্রভৃতি মিশনারীরা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য দেশি ভাষার আশ্রয় নিতে মনস্থ করলেন। ১৮০০ সালে কেরি ‘মঙ্গল সমাচার মতিউর রচিত’ (St Mathews Gospal) মুদ্রিত করে প্রকাশ করলেন। ১৮০১ সালে সম্পূর্ণ New Testament এবং Old Testament-এর কতকাংশ অনূদিত হয়ে প্রকশিত হল। ১৮০৯ সালে ধর্মপুস্তক নামে সমগ্র বাইবেলের অনুবাদ প্রকাশিত হল। এই বাইবেলের ভাষা অত্যন্ত জড় এবং কৃত্রিম। বাংলার নিজস্ব পদবিন্যাসের প্রতি দৃষ্টিপাত না করে ইংরেজি পদবিন্যাসের অনুসরণ করায় এ গদ্য পরবর্তী বাঙালিদের কাছে পরিহাসের বিষয় হয়ে পড়েছিল।
 
গদ্যভাষার দিক থেকে শ্রীরামপুর মিশন ও শ্রীরামপুর প্রেস এর ভূমিকা উল্লেখ্য নয়। কিন্তু এঁদের প্রচেষ্টায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারত এবং কয়েকখানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হওয়ায় বাঙালির কাছে শ্রীরামপুর মিশন আদরণীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। তা ছাড়া বাংলা ভাষায় ব্যাকরণবাংলা-ইংরেজি অভিধানবাংলা সাময়িকপত্র এই মিশনারীগণের যারা প্রকাশিত হল। বাংলা ভাষার উন্নতিতে এদের অস্বীকার করা চলে না। কয়েকখানি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃত গ্রন্থ সম্পাদনা ও মুদ্রণে কেরি এবং তাঁর সহকারীবৃন্দের প্রয়াস ছিল প্রশংসনীয়।



 

 


 

 

আরো পড়ুন--  রামমোহন রায় (১৭৭৪ – ১৮৩৩ খ্রি.)

———————————————————-
সাহায্য- ক্ষেত্রগুপ্ত
———————————————————-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!