Menu

প্রাকৃতপৈঙ্গল

Last Update : June 8, 2024

প্রাকৃতপৈঙ্গল

প্রাকৃতপৈঙ্গল কী?


ভাব, বিষয়বস্তু ও ভাষা-কৌশলের দিক থেকে এই গ্রন্থটি বাঙালী জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। গ্রন্থটি শৌরসেনী প্রাকৃত ও অপভ্রংশে লেখা হয়। বিভিন্ন কবি-রচিত শ্লোকের সঙ্কলন। সংকলকের নাম, পিঙ্গল। ইনি ‘পিঙ্গল ছন্দসূত্র‘ গ্রন্থাকার নন। পণ্ডিতজনের অনুমান, ১৪শ শতাব্দীতে কাশীধামে ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’ সঙ্কলিত হয়। এই গ্রন্থেও রাধা ও গােপালীলার উল্লেখ আছে, আছে বিভিন্ন দেবদেবীর সঙ্গে ‘রাই’-এর উল্লেখ এবং শিবের প্রসঙ্গ, আর বাঙালীর জীবনভােগের স্বাদু সংবাদ-

ওগ্গ‌রা ভত্তা, রম্ভঅ  পত্তা।

গাইক ঘিত্তা, দুগ্ধ সযুক্তা।

মৌইলি মচ্ছা, নালিতে গচ্ছা।

দিজ্জই কান্তা, খায় পুণ্যবন্তা ॥

অর্থাৎ, ওগরানাে ভাত কলা পাতায় ঢালা, গাওয়া ঘি, সুস্বাদু দুধ, মৌরলা মাছ, নালতে শাক রন্ধন করলেন কান্তা। কান্তা দিচ্ছেন, পুণ্যবান আহার করছেন।

এই রকম পল্লীবাসী কৃষি-নির্ভর প্রাচীন বাঙালী মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পরিচয় ‘প্রাকৃত পৈঙ্গলে’র আর একটি পদে পাওয়া যায়–

পুত্ত পবিত্ত বহুত্ত ধণা ভত্তি কুটুম্বিণি সুদ্ধমণা।

হাক্ক তরাসই ভিচ্চগণা কো কর বব্বর সগ্গ‌মণা ॥

(বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব)

অর্থাৎ, পুত্র পবিত্রমনা, প্রচুর ধন, স্ত্রী ও কুটুম্বিনীরা শুদ্ধচিত্তা, হাঁকে ত্রস্ত হয় ভৃত্যগণ-এই সব ছেড়ে কোন বর্বর স্বর্গে যেতে চায়।

এইভাবে দেখা যায় কয়েক শতক ধরে আলংকারিকদের বহু নিয়মের গণ্ডী পেরিয়ে, অনেক কবির শব্দ-সন্ধানের নিদ্রাহীন রাত ছুঁয়ে মাগধী অপভ্রংশের জঠর থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলা ভাষার ছােট্ট প্রাণ। তারপর আস্তে আস্তে ডানা মেলে একসময় কাপিয়ে পড়েছে মধ্যযুগের আকাশে আপনাকে জানতে-বুঝতে-চিনতে।

সংযোজন ১

পুরাতন বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় প্রাকৃতপৈঙ্গল কেন?


যে দুটি মুখ্য সংকলন, অর্থাৎ ‘গাথাসপ্তশতী’ ও ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’-যার কোনো কোনো শ্লোকের সঙ্গে প্রাচীন বাংলা কাব্যের কিছু সমভাবের ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যাবে। সে দুটি সংকলনই বাংলাদেশের নয়, কিন্তু তাতে পুরাতন বাঙালিজীবনের কিছু কিছু চিত্র আছে বলেই বাংলা সাহিত্যের পুরাতন যুগের ইতিহাস প্রসঙ্গে তার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

[প্রাকৃতপৈঙ্গল] মধ্যযুগের বাংলা বৈষ্ণব পদে হালের গাথাসপ্তশতী-র চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। এটি একখানি সংস্কৃত গ্রন্থ, যার বিষয়বস্তু-প্রাকৃত ছন্দ, দৃষ্টান্তগুলি শৌরসেনী প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত। গ্রন্থটি অতি বিখ্যাত ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’। এতে এমন অনেক-গুলি প্রাকৃত-অপভ্রংশ শ্লোক গৃহীত হয়েছে যার সঙ্গে বাংলা বৈষ্ণব পদাবলীর কোনো কোনোটির বিশেষ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যাবে—ভাব, বিষয়বস্তু ও ভাষা- ভঙ্গিমা অনেকটা পুরাতন বাংলা পদাবলীর মতো। মাত্রাবৃত্ত ও বর্ণবৃত্ত-এই দু’ধরনের প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ছন্দের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে সংকলক পিঙ্গল অনেক শ্লোক উল্লেখ করেছেন। 

আরো পড়ুন--  তুর্কি আক্রমণ, বাংলা সাহিত্যে তার প্রভাব

পিঙ্গলসূত্রের রচয়িতা পিঙ্গল আর প্রাকৃতপৈঙ্গল এর সংকলক পিঙ্গল কি একই ব্যক্তি?


এই সংকলনে বিভিন্ন কবির রচনা উদ্ধৃত হয়েছে, তার মধ্যে কিছু কিছু বাঙালি কবির রচনাও আছে। এ সংকলন চতুর্দশ শতাব্দীতে বারাণসীধামে প্রস্তুত হয়েছিল। এর সংকলক সাহিত্যের ইতিহাসে পিঙ্গল নামে পরিচিত। ‘পিঙ্গলছন্দ-সূত্রে’র লেখক পিঙ্গল এবং ‘প্রাকৃতপৈঙ্গলে’র রচনাকার কি একই ব্যক্তি? বাহ্যত তাই মনে হয়। কিন্তু এ রকম সিদ্ধান্তের বিপরীত প্রমাণও আছে। ‘প্রাকৃতপৈঙ্গলে’র অনেক পূর্বে রচিত ‘পিঙ্গলছন্দ-সূত্র’। সুতরাং মনে হচ্ছে দু’ জন পৃথক ব্যক্তি, বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। হয়তো ‘পিঙ্গলছন্দ-সূত্র’ অধিকতর জনপ্রিয় ছিল বলে কোনো প্রাকৃত ছন্দকার এই পিঙ্গলের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকবেন।

প্রাকৃতপৈঙ্গলে বাঙালি জীবনের চিত্র


সে যাই হোক, ‘প্রাকৃতপৈঙ্গলে’ উল্লিখিত প্রাকৃত-অপভ্রংশ শ্লোকে মাঝে মাঝে বাঙালিজীবনের স্পর্শ পাওয়া যায় তা অস্বীকার করা যায় না। রাধাকৃষ্ণ ও কৃষ্ণগোপী-লীলাসংক্রান্ত কিছু শ্লোক থাকলেও এতে বাঙালিজীবনের ধূসর ও রুক্ষ চিত্রই অধিকতর স্বাভাবিক ও জীবন্ত হয়েছে। দু-একটি দেব-দেবী-বিষয়ক শ্লোক আগে উদ্ধৃত করি। কৃষ্ণলীলার পদ :

অরে রে বাহিহি কাহ্ন নাব ছোড়ি ডগমগ কুগই ণ দেহি।

তুহুঁ এখণই সন্তার দেই জো চাহসি সো লেহি।
  • ওহে কৃষ্ণ, নৌকা বাইছ, ডগমগ (নৌকা টলমল করা) ছাড়ো, আমাদের দুর্গতির মধ্যে ফেলো না, এখনই পার করে দিয়ে যা চাও তা নাও। 

এর সঙ্গে বীরত্বব্যঞ্জক কৃষ্ণলীলার এ পদটিও উল্লেখযোগ্য :

জিনি কংস বিণাসিঅ কিত্তি পআসিঅ

মুট্ট অরিট্টি বিনাস করে

গিরি হুত্থ ধরে।
  • যিনি কংস বিনাশ করে কীর্তি প্রসারিত করেছেন, মুষ্টিক অরিষ্টাদি হত্যা করেছিলেন এবং স্বহস্তে গিরি (গোবর্ধন) ধারণ করেছিলেন। 

কৃষ্ণবিষয়ক পদে রাধারও (রাঈ) উল্লেখ লক্ষ করা যায়। দু-একটি পদে শিবেরও উল্লেখ আছে। কিন্তু বাঙালির স্বাদু জীবনভোগের চিত্রটি অতি উপাদেয় হয়েছে :

ওগ্গ‌রা ভত্তা, রম্ভঅ  পত্তা।

গাইক ঘিত্তা, দুগ্ধ সযুক্তা।

মৌইলি মচ্ছা, নালিতে গচ্ছা।

দিজ্জই কান্তা, খায় পুণ্যবন্তা ॥
  • ওগরা ভাত (ফ্যানা ভাত) কলাপাতায় বেড়ে দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আছে গাওয়া ঘি, সুস্বাদু দুধ, মৌরলা মাছ, নালতে (পাট) শাক, রন্ধন করেছেন কান্তা স্ত্রী, পরিবেশন করছেন কান্তকে, এই খাদ্য যিনি আহার করেছেন, তিনি সত্যই পুণ্যবান।

এ আয়োজন আদৌ রাজসিক নয়, আবার সাত্ত্বিকও নয়, কারণ আমিষের গন্ধ আছে। সেকালের পক্ষে এ আয়োজন সামান্যই। কিন্তু কান্তার রান্না পরিবেশনে স্বামী নিজেকে পুণ্যবান মনে করছেন এ চিত্রটি ঘরোয়া হলেও বড়ো শুচিস্নিগ্ধ। বস্তুত এই অপভ্রংশে রচিত শ্লোকগুলিতে বাঙালি জীবনের চমৎকার রূপ ফুটে উঠেছে। 

আরো পড়ুন--  আর্যাতর্জা কী

সেকালের মানুষের কতটুকুই বা আকাঙ্ক্ষা ছিল – “আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে”-এই সীমাবদ্ধ ইচ্ছাই বাঙালিকে দুঃখদারিদ্র্যের মধ্যে শান্ত ও নিরুদ্বিগ্ন রাখতে পেরেছে। কিন্তু দু-একটি পদে জীবনের বঞ্চিত ও বিষণ্ণ দিকটিও স্বীকৃত হয়েছে। যেমন :

রাআ লুব্ধ সমাজ খল, 

বহু কলহারিণ সেবক ধুত্তউ।।

জীবন চাহসি সুক্‌খ জই,

পরিহর ঘর জই বহু গুণ জুত্তউ।।
  • রাজা লোভী, সমাজ খল, স্ত্রী মুখরা, পরিচারক ধূর্ত, যদি সুখ চাও তো বহু সুখের আকর গৃহও পরিত্যাগ করো।

এ-তো আমাদের সমাজের অতি প্রত্যক্ষ চিত্র। দেখা যাচ্ছে, যুগভেদে সুখভোগের পার্থক্য থাকলেও দুঃখের চিত্রটা একই ধরনের।

প্রাকৃতপৈঙ্গল এর কবিতাগুলির রচনাকাল


এই শ্লোকগুলি ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল বলে, এতে নব্যভারতীয় ভাষার অল্পস্বল্প প্রভাব ফুটে উঠেছে। অবশ্য এ সংকলন বাংলাদেশে প্রস্তুত হয়নি, এবং সংকলকও যে বাঙালি ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না, তবু কোনো কোনো শ্লোকে বাঙালি জীবনের ছায়াপাত হয়েছে বলে মধ্যযুগের বাংলা কাব্য-কবিতা প্রসঙ্গে ‘প্রাকৃতপৈঙ্গলে’র উল্লেখ থাকা বাঞ্ছনীয়। কৃষ্ণের গোপীলীলা, প্রকৃতিচিত্র, প্রতিদিনের জীবনের সুখ-দুঃখ বাঙালির জীবন-চর্যাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

আরো পড়ুন--  রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় সাহিত্যচর্চা

প্রাকৃতপৈঙ্গল এর সংকলক পিঙ্গল-এর পরিচয়


 কিন্তু সংকলক পিঙ্গল (?) কি অবাঙালি ছিলেন? কারণ সংকলিত কোনো কোনো শ্লোকে বাঙালির প্রতি কিছু কটাক্ষপাত আছে। ‘ভঅ ভগ্নিঅ বন্দা’ (ভয়ে বাঙালিরা রণে ভঙ্গ দিল), ‘বঙ্গলা ভঙ্গলা’ (বাঙালিরা ভেগে গেল) এ-সব মন্তব্য বাঙালির গৌরবের সূচনা নয়। আরো আছে :

রে গৌড় থক্কন্তি তে হত্থি জুহাই।

পল্লট্টি জুজ্‌ঝাহি পাইক্ক-বুহাই।।
  • ওরে গৌড়, তোর হাতীর দল থাকুক, বরং এগিয়ে এসে পাইকদের সঙ্গে লড়াই কর্।

দেখা যাচ্ছে, এই শ্লোককার বঙ্গ ও গৌড় (অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ) উভয়-অঞ্চলের সৈন্য সামন্তদের বীরত্ব লঘু করতে চেয়েছেন। এই কবি কাশীশ্বরের স্তুতি গাইতে গিয়ে কলিঙ্গ, তৈলঙ্গ (অর্থাৎ অন্ধ্রদেশবাসী, তেলেঙ্গা), মারাঠা, সৌরাষ্ট্র, চম্পারণ (ভাগলপুরের নিকটবর্তী), ওড্র, ম্লেচ্ছ প্রভৃতি অঞ্চলের সৈন্য-বাহিনীর বীরত্ব উড়িয়ে দিয়েছেন। ‘কাসীসর রাণা কিঅউ পআণা’ (কাশীশ্বর রাজা অভিযান করছেন)। সুতরাং আর সকলে তো ভয়ে পালাবেই। পিঙ্গল নামে কোনো ব্যক্তি (হয়তো ছদ্মনাম) যিনি এই সংকলন প্রস্তুত করেছিলেন, হয়তো নিজেও কোনো কোনো শ্লোকের রচনাকার, তিনি সম্ভবত তাঁর পৃষ্ঠপোষক কাশীরাজের গুণগাণ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের বলবীর্য তুচ্ছ করতে চেয়েছেন। সেকালের রাজসেবক কবি ও পণ্ডিতদের এইভাবে চাটুকারবৃত্তি অবলম্বন করতে হত, কারণ ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’। 

সে যাই হোক, মধ্যযুগের বাঙালি-জীবনচিত্র হিসেবে ‘গাথাসপ্তশতী’ ও ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’ কথঞ্চিৎ উল্লেখযোগ্য, কারণ পুরাতন বাংলা কাব্যে এই সমস্ত শ্লোকের অল্পস্বল্প প্রভাব আছে। 

(অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড)


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!