Menu

কবি গোবিন্দদাস, 16শ শতকের কবি

কবি গোবিন্দদাস
কবি গোবিন্দদাস

কবি গোবিন্দদাস, 16শ শতকের কবি, সাধারণ আলোচনা

সূচনা

চৈতন্যোত্তর পদাবলী সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি গোবিন্দদাস। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রে ও বৈষ্ণবীয় দর্শনে সুপণ্ডিত গোবিন্দদাস বিধিদত্ত কবিপ্রতিভার সাহায্যে ছন্দসংগীতের বাণীশিল্পে যে অপূর্ব সৌন্দর্যের জগৎ সৃষ্টি করেছেন সেক্ষেত্রে তিনি জয়দেব-বিদ্যাপতিভারতচন্দ্রের সমগোত্রীয়। কিন্তু কাব্যাদর্শের দিক থেকে তিনি বিদ্যাপতিকে বিশেষভাবে অনুসরণ করেছেন। তাই বিদ্যাপতির সঙ্গে তাঁর ভাবগত আত্ময়ীতা বেশি। বিদ্যাপতির অনেক খণ্ডিত বা অসম্পূর্ণ পদ তিনি সম্পূর্ণ করে ‘বিদ্যাপতি গোবিন্দদাস‘- যুগ্ম ভণিতা যোগ করেছেন। বিদ্যাপতির মতোই গোবিন্দদাস অনেক প্রভাবপ্রতিপত্তিশালী জমিদারের কাছে সম্বর্ধিত হন। বিদ্যাপতি যেমন জয়দেবের কাব্যাদর্শ অনুসরণ করে ‘অভিনব জয়দেব‘ অভিধায় ভূষিত হয়েছেন, গোবিন্দদাস তেমনি বিদ্যাপতির অনুরূপ ভাষাভঙ্গি, ছন্দোলালিত্য ও অলংকারসমৃদ্ধ ভাবের রূপনির্মিতিতে “দ্বিতীয় বিদ্যাপতি” নামে আখ্যাত। 

বিদ্যাপতির সঙ্গে গোবিন্দদাসের ভাব-সাদৃশ্যের দিকে লক্ষ্য রেখে সমসাময়িক শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য বল্লভদাস সপ্রশংস মন্তব্য করেছেন-

“ব্রজের মধুর লীলা / যা শুনি দরবে শিলা

গাইলেন কবি বিদ্যাপতি।

তাহা হৈতে নহে ন্যূন / গোবিন্দের কবিত্বগুণ

গোবিন্দ দ্বিতীয় বিদ্যাপতি।”

গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বটে। কিন্তু বৈষ্ণবীয় তত্ত্বের ভাবানুভূতির প্রকাশে, জীবনদৃষ্টির গভীরতায় ও তত্ত্বের রসসৌকর্যসাধনে ও মণ্ডনকলার শিল্পদ্যোতনায় গোবিন্দদাস বহুস্থলে বিদ্যাপতির থেকেও উচ্চস্তরের কবি। গোবিন্দদাসের পদাবলী পড়ে বৃন্দাবনের শ্রীজীব গোস্বমী তাঁকে ‘কবীন্দ্র’ বলে সম্মানিত করেছিলেন। তদবধি গোবিন্দদাস ‘কবিরাজ’ নামে খ্যাত।

আরো পড়ুন--  বিদ্যাপতির জীবন ইতিহাস, Best unique 5 points

কবি গোবিন্দদাস : জীবনী

গোবিন্দদাস বৈষ্ণব সমাজে ও সাহিত্যে শ্রদ্ধেয় কবিরূপে সমাদৃত হয়েছিলেন বলে তাঁর জীবন সম্পর্কে নানা কথা জানা গেছে। তিনি ১৫৭৩ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি কোনো সময়ে কাটোয়ার শ্রীখণ্ডে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। মাতামহ বিখ্যাত পণ্ডিত দামোদর সেন। পিতার নাম চিরঞ্জীব সেন ও মাতা সুনন্দা দেবী। কবিরা জাতিতে বৈদ্য। পিতা চিরঞ্জীব বৈষ্ণব ভাবাপন্ন ও শ্রীচৈতন্যের ভক্ত ছিলেন। কবির আদিনিবাস ছিল কুমার নগরে। আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো সময়ে কবির তিরোধান ঘটে। 

ড. বিমানবিহারী মজুমদারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গোবিন্দ দাস ১৫৩৭ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন, ১৫৭৭ খ্রীষ্টাব্দে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন এবং ১৬১৬ খ্রীষ্টাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন। মাতামহের আদর্শে গোবিন্দদাস প্রথম জীবনে শাক্ত ধর্মে দীক্ষিত হন। পরবর্তীকালে তিনি শ্রীনিবাস আচার্যের নিকট বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। কথিত আছে চল্লিশ বছর বয়সে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করার পরই তাঁর মুখে ব্রজবুলিতে কৃষ্ণবন্দনার একটি পদ স্ফুরিত হয় – “ভজহুঁরে মন নন্দনন্দন অভয় চরণারবিন্দুরে।” 

গোবিন্দদাসের পুত্র দিব্যসিংহ ও পৌত্র ঘনশ্যাম দাস বৈষ্ণব সমাজে ও সাহিত্যে সুপরিচিত। আসল কথা, সংস্কৃতিবান পরিবারে গোবিন্দদাসের জন্ম। সংস্কৃত সাহিত্য ও অলংকারশাস্ত্রে তিনি ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। সংস্কৃতে ‘সঙ্গীত মাধব‘ নামে একটি নাটক তিনি রচনা করেন। কিন্তু ব্রজবুলি ভাষায় পদরচনার জন্যই তিনি যশোমন্দিরে চিরস্থায়ী প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত রাগানুগা ভক্তির ঐতিহ্য নিয়েই কাব্যক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব। তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবিখ্যাতির অধিকারী।

আরো পড়ুন--  অষ্টাদশ শতাব্দীর বৈষ্ণব পদ সংকলন গ্রন্থ

কবি গোবিন্দদাস : কাব্যবৈশিষ্ট্য

ষোড়শ শতাব্দী বাংলা সাহিত্যের সুবর্ণযুগ নামে চিহ্নিত। এই যুগকে স্বর্ণ বিভায় মণ্ডিত করেন গোবিন্দদাস। তিনি বৈষ্ণব কাব্যধারাকে পরিণতি দান করেছেন। বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হয়ে গোবিন্দ দাস রূপগোস্বামীর ‘ভক্তি রসামৃত সিন্ধু’ ও ‘উজ্জ্বল নীলমণি’ আয়ত্ত করে বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের আনুগত্যে রাধাকৃষ্ণ লীলার পদ রচনা করেন। বৃন্দাবনে তিনি যাননি। কিন্তু বৃন্দাবনের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র ছিল অবিচ্ছিন্ন। বৈষ্ণব গোস্বামীরা তাঁর ‘সঙ্গীতমাধব’ গ্রন্থ পড়ে কবিরাজ উপাধি দেন। রূপগোস্বামীর কাব্য, নাটক ও রসশাস্ত্র তিনি গভীর আগ্রহ ও যত্নসহকারে পাঠ করেন। রূপ গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর নিয়মিত পত্র ব্যবহার ছিল। গোবিন্দদাসের কাব্য সংস্কার ষড় গোস্বামীদের প্রভাবে গড়ে ওঠে। সংস্কৃত কাব্য, অলঙ্কার শাস্ত্রে ও বৈষ্ণবীয় তত্ত্বদর্শনে অধিকার না থাকলে গোবিন্দদাসের পদের সামগ্রিক রস সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যাবে না।

গোবিন্দদাস ভক্ত, সাধক ও রূপদক্ষ শিল্পী। ভক্তিভাবের নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা এবং কাব্যিক মনন উৎকর্ষ তাঁকে কালজয়ী কবিত্বের স্বর্ণমুকুট পরিয়ে দিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহ যে, চৈতন্যোত্তর যুগের তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ পদকার। বিদ্যা ও পাণ্ডিত্যের সঙ্গে তাঁর শিল্পচেতনার অপৃথক যত্ন’-সমন্বয় সাধিত হয়েছে। ভাষা, ছন্দ, অলংকার, চিত্র ও সঙ্গীতের সুযম মিলনে ব্রজবুলিতে লেখা তাঁর কবিতাগুলি সৃজনশীলতার অভিনব শিল্পসামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। গোবিন্দদাসের কবিপ্রকৃতি অলংকারশাস্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় তাঁর কবিতাবলী সংস্কৃত ভাষার সুললিত মাধুর্য ও ক্লাসিক সংহতির সুমহান গাম্ভীর্যে দীপ্যমান।

আরো পড়ুন--  কবি রায়শেখর, 16শ শতকের কবি

গোবিন্দদাস নিষ্ঠাবান ভক্ত কবি। গোবিন্দদাস গৌরলীলা ও রাধাকৃষ্ণলীলার পূর্বরাগ, অভিসার, বাসকসজ্জা, বিপ্রলব্ধ, খণ্ডিতা ও মাথুর প্রভৃতি বিভিন্ন পর্যায়ের পদকর্তা। তাঁর গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যে ভক্তি তন্ময়তার একক নিদর্শন। একজন রূপদক্ষ শিল্পীর ভাবের গূঢ়তা ও গাঢ়তা, আলংকারিক শিল্প নৈপুণ্য, চিত্র ও সংগীতধর্মিতা এস্থলে অসাধারণ কাব্যগৌরবে উজ্জ্বল। দিব্য-ভাবচঞ্চল মহাপ্রভুর অন্তর্জীবনের নিখুঁত লীলাচিত্র গোবিন্দদাস দক্ষ সচেতন শিল্পীর মতো ধীরস্থির তুলির টানে অতীব বর্ণাঢ্য ও সুস্পষ্ট করে তুলেছেন –

“নীরদ নয়নে / নীর ঘন সিঞ্চনে

পুলক মুকুল অবলম্ব।

বিন্দু বিন্দু চূয়ত / স্বেদ মকরন্দ

বিকশিত ভাবকদম্ব।

কি পেখলু নটবর গৌর কিশোর।

অভিনব হেম / কল্পতরু সঞ্চরু

সুরধনী তীরে উজোর।”

মহাপ্রভুর শান্তপূণ্য করুণাঘন দিব্যজীবন ও তাঁর প্রেমাদর্শ রূপে রসে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে উক্ত কবিতায়। শ্রীচৈতন্যের মানবিক ও অতিলৌকিক রূপ, শ্রীচৈতন্য সম্পর্কিত বৈষ্ণবীয় ধারণার তত্ত্বাদর্শ গোবিন্দদাসের লেখনীতে অনুপম কবিত্বমণ্ডিত হয়ে উঠেছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!