Menu

পদাবলির কবি চণ্ডীদাস, 15শ শতকের কবি

Last Update : January 19, 2024

পদাবলির কবি চণ্ডীদাস
পদাবলির কবি চণ্ডীদাস

পদাবলির কবি চণ্ডীদাস, 15শ শতকের কবি

ভূমিকা

চৈতন্য-পূর্ব যুগে বিদ্যাপতির সমসাময়িক একজন শ্রেষ্ঠ রাধাকৃষ্ণ পদাবলী রচয়িতা কবি চণ্ডীদাস। বাংলা ভাষায় তিনি প্রথম পদাবলী রচনা করেন। তাই তাঁকে সাধারণভাবে পদকর্তা চণ্ডীদাস বলা হয়। কিন্তু চণ্ডীদাসকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। চণ্ডীদাস নামধারী অন্তত চারজন কবি ছিলেন বলে পণ্ডিতরা নানা তথ্য বা উপাদানকে কেন্দ্র করে চণ্ডীদাস সমস্যার সমাধানে প্রয়াসী হয়েছেন। বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে চণ্ডীদাসের স্থান অতি উচ্চ। অল্পকথায়, সহজ ও অনলংকৃত ভাষায় তাঁর পদে প্রেমানুভূতির গভীরতা ও আন্তরিকতা ফুটে উঠেছে।

পদাবলির কবি চণ্ডীদাস : পরিচয়

চণ্ডীদাসের ব্যক্তিপরিচয় তেমন কিছু জানা যায় না। জনশ্রুতি অনুসারে তিনি বীরভূম জেলার নান্নুর গ্রামে বাস করতেন। জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। প্রথমে বাশুলী বা চণ্ডীর উপাসক হলেও পরে সহজ মার্গের সাধনায় ব্রতী হন। ইনি রামী নামে এক রজক কন্যাকে সাধনসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করেন। রজকিনী রামীর কথা কোনো কোনো পদে পাওয়া যায়। যেমন একটি দৃষ্টান্ত – “রাজকিনী প্রেম । নিকষিত হেম। কামগন্ধ নাহি তায়।” কথিত আছে যে চণ্ডীদাস এক রাজার ক্রোধে পতিত হন এবং হস্তিপদতলে দলিতপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারান।

আরো পড়ুন--  বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতি সমস্যা, Discuss with best unique 3 points

পদাবলির কবি চণ্ডীদাস : সাধারণ আলোচনা

চণ্ডীদাসের পদাবলীর রাধা এক সূক্ষ্মভাবের জ্যোতির্ময়ী বিগ্রহ। জন্ম থেকেই তিনি কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদিনী। জন্মা-জন্মান্তরে তিনি কৃষ্ণগতপ্রাণা-দুঃখ বেদনায় আধ্যাত্মিক জগতের অভিযাত্রী। তাই চণ্ডীদাসের রাধা চরিত্রে কোনো ক্রমবিকাশ নেই। পূর্বরাগ, অনুরাগ, বিরহ ও মিলন প্রভৃতি বিচিত্র পর্যায়ের পদ চণ্ডীদাস লিখলেও সব পদেই প্রেমানুভূতিতে বিরহ প্রবল। চণ্ডীদাস বেদনার কবি, আক্ষেপানুরাগের কবি। বয়সের দিক থেকে রাধা ক্রমবিকশিত নন। দেহধর্ম ও যৌবনধর্ম বা ইন্দ্রিয় বোধ নয়-হৃদয়ের এক গভীর ব্যাকুলতায় রাধার প্রধান পরিচয়। 

রাধা সব বাসনা কামনা ও সৌন্দর্য চেতনা মিশিয়ে কৃষ্ণকে তৈরী করেছেন। কৃষ্ণ তার মনের মানুষ। কৃষ্ণনাম জপ করতে করতে তাঁর প্রাণ অবশ হয়ে যায়–তিনি প্রণয় মিলন ও প্রণয় বিরহের এক অপূর্ব সৌন্দর্যময় রোমান্টিক রাজ্যে গিয়ে হাজির হন। দেহকেন্দ্রিক মিলন বা প্রেমরঙ্গলীলার তরঙ্গ বিক্ষোভ চণ্ডীদাসের পদে নেই। তাঁর রাধাকৃষ্ণের প্রেম ও মিলনের বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের ভাষায় দেহহীন চামেলির লাবণ্য বিলাসের বেদনাবিধুর অনুরাগ ফুটে উঠেছে। চণ্ডীদাস দেহের কবি নন, দৈহিক মিলনানন্দের কবি নন। অবশ্য চণ্ডীদাসের পদে দেহ সৌন্দর্যের কিছু কিছু বর্ণনা আছে। সেগুলি রাধার দেহলাবণ্যে আকৃষ্ট মুগ্ধ শ্রীকৃষ্ণের উক্তি।

আরো পড়ুন--  কবি গোবিন্দদাস, 16শ শতকের কবি

রবীন্দ্রনাথ চণ্ডীদাসের পদাবলী আলোচনা করতে গিয়ে রাধার প্রেম সাধনাকে গুরুগ দিয়েছেন। তাঁর মতে, “চণ্ডীদাস সহজভাষার সহজভাবের কবি-এই গুণে তিনি বঙ্গীয় প্রাচীন কবিদের মধ্যে প্রধান কবি।”

চণ্ডীদাসের কবিতায় রাধার যে প্রেম তা এক গভীরতম জীবনবোধের নির্যাস। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, চণ্ডীদাস দুঃখের কবি। দুঃখবোধের নিবিড়তার মধ্য দিয়েই চণ্ডীদাসের পদাবলীতে প্রেমের জগৎ তৈরী হয়েছে। চণ্ডীদাস দুঃখের মধ্যে সুখ ও সুখের মধ্যে দুঃখকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর রাধা প্রেমের সাধনায় ব্যাকুল ও গভীর। চরম ও পরম কিছুকে পেতে হলে অজস্র দুঃখ বেদনার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। চণ্ডীদাসের রাধা জানেন, “সত্য যে কঠিন” ; কিন্তু তাকে ভালবাসলে সেই কঠিন কখনো কাউকে বঞ্চনা করে না।

চণ্ডীদাসের রাধা জানেন – “সুখের লাগিয়া/যে করে পীরিতি/দুঃখ যায় তার ঠাঁই।” পীরিতি করতে গেলে দুঃখ অনিবার্য। তাই বলে প্রেমকে পরিত্যাগ করা যায় না। কঠোর দুঃখের সাধনায় প্রেমের স্বর্গীয় দ্যুতি ফুটে উঠে। এটা উপলব্ধির ব্যাপার–কথায় ব্যাখ্যা করা যায় না। চণ্ডীদাসের পদাবলীতে প্রেমের শ্রেয়োবোধ অপার্থিব রসলোক সৃষ্টি করেছে। সেখানে উপভোগের কামগন্ধ নেই। আছে আত্মানুভূতির নিবিড় আনন্দ। চণ্ডীদাসের পদে দেহ ও রূপসৌন্দর্যের দিকটা যথেষ্ট উপেক্ষিত বলে তার আধ্যাত্মিক ভাবুকতা সকলের চিত্তকে আকৃষ্ট করে।

আরো পড়ুন--  কবি বিদ্যাপতি ও ব্রজবুলি ভাষা

এই যে প্রেমের সাধনা তা প্রকৃতপক্ষে ‘বড় আমি’র সাধনা। সেই সাধনায় কুলশীল, জাতিমান সব পরিত্যাগ করতে হয়–পরকে আপন করতে হয় ও আপনকে পর করতে হয়। পদে পদে রক্তের পদচিহ্ন এঁকে কুল খোয়ানো অভিসার যাত্রায় বেরিয়ে পড়তে হয়। এমন কি প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয় –

চণ্ডীদাস বলে শুন বিনোদিনী

পীরিতি না কহে কথা।

পীরিতি লাগিয়া পরাণ ছাড়িলে

পীরিতি মিলয়ে তথা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!