Menu

কবি জ্ঞানদাস, 16শ শতকের কবি

কবি জ্ঞানদাস
কবি জ্ঞানদাস

কবি জ্ঞানদাস, 16শ শতকের কবি, সাধারণ আলোচনা

চৈতন্য-পরবর্তীকালের একজন সুবিখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা জ্ঞানদাস। বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দ দাস – এই চারজন কবিই প্রতিনিধি স্থানীয় কবি ও নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। জ্ঞানদাসের জীবন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তেমন কোনো আত্ম-পরিচয় তথ্য পাওয়া যায়নি। বর্ধমান জেলার কাটোয়ার নিকট কাঁদড়া গ্রামের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে আনুমানিক ১৫৩০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। ইনি নিত্যানন্দের পত্নী জাহ্নবী দেবীর নিকট বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন। নিত্যানন্দের তিরোধানের কিছুদিন পরে তিনি জাহ্নবী দেবীর সঙ্গে বৃন্দাবনে তীর্থ করতে যান।

বৃন্দাবনে জ্ঞানদাস শ্রীজীব, রঘুনাথ দাস, গোপালভট্ট ও কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রভৃতি বিখ্যাত বৈষ্ণবাচার্যদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। জ্ঞানদাস, নরোত্তম দাস আয়োজিত খেতুরীর কবি সম্মেলনে যোগ দেন। সেই অনুষ্ঠানে গোবিন্দদাস কবিরাজ ও বলরামদাসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এর বেশী কিছু তাঁর সম্পর্কে জানা যায়নি। 

কবি চিরকুমার ছিলেন। জ্ঞানদাসের ভণিতায় প্রায় চারশত পদ পাওয়া গেছে। কিন্তু সব পদই তাঁর রচনা বলে মনে হয় না। কারণ, তার মধ্যে অনেক নিকৃষ্ট কবিতা রয়েছে। মনে হয় অল্প প্রতিভাশালী কবিরা জ্ঞানদাসের নামে কবিতাগুলি চালিয়ে দিয়েছেন, কিংবা একাধিক চণ্ডীদাসের মতো একাধিক জ্ঞানদাস বর্তমান ছিলেন। শ্রীসুকুমার ভট্টাচার্য এম. এ. ১৩৪৭ সালে ‘যশোদার বাৎসল্য লীলা’ নামে এক পুঁথি আবিষ্কার করে প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে জ্ঞানদাসের ভণিতায় কুড়িটি পদ স্থান পেয়েছে। ভণিতার কথনরীতি ও ভাষাভঙ্গিমা বিচারে পদগুলিতে জ্ঞানদাসের আবেগের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, ব্যঞ্জনা ও গীতিকবিতার উচ্ছ্বাস নেই। কাজেই অনুমান করা যায় যে, সেগুলি জ্ঞানদাসের রচনা নয়।

আরো পড়ুন--  কবি বিদ্যাপতির রচনাবলী, Discuss with Best Unique 11 Points

কাব্যের সাধারণ পরিচয়

জ্ঞানদাস বৈষ্ণবভক্ত কবি। তাঁকে “চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য” বলা হয়। চণ্ডীদাসের মতোই জ্ঞানদাসের পদে প্রকাশরীতির সরলতা ও ভাবের গভীরতা লক্ষ্য করা যায়। জ্ঞানদাস বাংলা ও ব্রজবুলি উভয় ভাষাতেই কবিতা রচনা করেছেন। তবে বাংলা ভাষায় রচিত কবিতাতেই তাঁর প্রতিভার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। ব্রজবুলির পদে কবি বিদ্যাপতিকে অনুসরণ করায় সেগুলি কাব্যসৌন্দর্যের গৌরব অর্জন করতে পারেনি। বাংলাভাষায় রচিত কবিতাবলীতে ভাবের সরলতা ও অনুভূতির গভীরতা অলংকার-বিরল সহজ ভাষায় অনবদ্য শিল্পমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। 

জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভার স্বকীয়তা বাংলা ভাষার পদেই দীপ্যমান হয়ে উঠেছে। ব্রজবুলিতে জ্ঞানদাসের কবিকল্পনার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ কোনো কোনো কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে বটে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সচেতন অনুকরণ নীরস কৃত্রিমতায় পর্যবসিত হয়েছে। ব্রজবুলির পদগুলি হিসাব করে লেখা। “ব্রজবুলি তাঁর কবিভাষা, প্রাণের ধাত্রী নয়।” যে বিশিষ্ট বাক্‌রীতি, রোমান্টিক কল্পনা জ্ঞানদাসের স্বকীয় প্রতিভার নিদর্শন তা ব্রজবুলির পদে নেই, বাংলা পদেই পরিস্ফুট হয়েছে। 

আরো পড়ুন--  ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮১২-১৮৫৯

জ্ঞানদাসকে ‘চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য’ বলা হয়। এর তাৎপর্য এই যে, সহজ প্রকাশভঙ্গি ও ভাবগভীরতার দিক্ থেকে উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য বর্তমান। কিন্তু চণ্ডীদাসের কবিতায় যে রহস্যঘন অতীন্দ্রিয় অনুভূতির দ্যোতনা ফুটে উঠেছে – জ্ঞানদাসের কবিতায় ততটা ভাববৈশিষ্ট্য নেই। তবে চণ্ডীদাসের মতো জ্ঞানদাসও রাধিকার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। জ্ঞানদাস আধ্যাত্মিক ভাবানুভূতির সঙ্গে মানবিক চেতনার আশ্চর্য সমন্বয় সাধন করেছেন। জ্ঞানদাস মিস্টিক ও রোমান্টিক কবি। তাঁর কবিতা রূপ ও অরূপের সঙ্গমতীর্থ। বৈষ্ণবের ভাবসাধনার উচ্চতম স্তরে তিনি বিচরণ করতে চেয়েছেন। প্রেমের অতল অসীম রহস্য, চিরন্তন অতৃপ্তি বোধ, মিলনের ব্যাকুলতা, বিরহের মর্মান্তিক দাহ ও স্বপ্নচারিতায় মিলনের আনন্দ ও নিবিড় প্রশান্তি প্রভৃতি প্রেমের বিচিত্র লীলা জ্ঞানদাসের পদগুলিতে সুন্দর শিল্পসৌকর্য লাভ করেছে।

জ্ঞানদাস শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা, নৌকাবিলাস ও দান খণ্ড প্রভৃতি বিষয়েও কবিতা লিখেছেন। কিন্তু তাঁর কবিপ্রতিভা পূর্বরাগ, আক্ষেপানুরাগ, মান, নিবেদন, রসোদগার, মিলন, বিরহ ও মুরলী শিক্ষা বিষয়ক পদগুলিতে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে গৌরব দ্যুতিময়। জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভার স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা ভাবের রূপশিল্প সৃষ্টিতে।

আরো পড়ুন--  কবি বিদ্যাপতি ও ব্রজবুলি ভাষা

রূপনির্মাণ শক্তিতে জ্ঞানদাস অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী। তাঁর কাব্য কবি কল্পনার অন্তর্নিহিত আবেগ থেকে জাত, একান্ত সজীব ও সুন্দর। এর জন্য জ্ঞানদাসকে চেষ্টা করে অলঙ্কার শাস্ত্রের আশ্রয় নিতে হয়নি। অন্তরের ভাবরাশিকে তিনি সৌন্দর্য রসে মূর্ত ও পরিস্ফুট করে তুলেছেন। 

জ্ঞানদাস একই সঙ্গে কবি ও শিল্পী। কবির ভাবাবেগকে সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী জনোচিত সূক্ষ্ম কারুকর্মে রূপ দিয়েছেন। নায়ক-নায়িকার রূপ বর্ণনা, প্রেমাবেগের তীব্র জ্বালা ও আর্তি, রূপবিভোরতা ও মিলন ব্যাকুলতাকে জ্ঞানদাস অনায়াসেই শিল্পশ্রীমণ্ডিত করে তুলেছেন। ভাব ও রূপের যুগলমূর্তি গঠনে তিনি অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: সংরক্ষিত !!